প্রবীর রায় : প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা। কলকাতা, ২ অক্টোবর, ২০২৫। শারদীয় উৎসবের আমেজ কি শুধু নীল আকাশ, ঘাসের শিশির, আকাশে ভেসে যাওয়া সাদা মেঘপুঞ্জে থাকে? চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, পুজো প্যান্ডেলের মাইকে ভেসে আসা সেই ভরাট কন্ঠসুধা, ঐ কপোলে দেখেছি লাল পদ্ম… কিংবা ওগো কাজল নয়না হরিণী.. কিংবা ও আকাশ সোনা সোনা …যাদুর মত খুলে যাওয়া মন- জানালায় হাজির বাঙালির মনোজগতের সুর নায়ক। আজও পুজোর প্যান্ডেল এ প্রতিনিয়ত বাজে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরেলা গান।
অনন্য সুরেলা কন্ঠে অজস্র হৃদয়গ্রাহী গান গেয়ে সুরের যাদুকর উপাধিতে আখ্যায়িত হয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। একজন খ্যাতিমান কন্ঠশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক- তিনি ছিলেন বাংলা গানের ধ্রুবতারা। অসাধারণ গায়কি আর সুমধুর গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠের ঔদার্যে তিনি চিরস্মরণীয়। বাংলা গানের এই অবিস্মরণীয় সুরস্রষ্টা তাঁর সৃষ্টি করা অবিস্মরণীয় সুরের প্লাবনে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন সারা বাংলা, সমগ্র উপমহাদেশ।
জন্ম ১৯২০র ১৬ই জুন বারানসীতে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি তাঁর পরিবার কলকাতায় আসে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ছিলেন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান। কিন্তু সঙ্গীতের জন্য পড়া শেষ হয় নি।
১৯৩৩ সালে শৈলেশ দত্তগুপ্তের সহযোগিতায় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র জন্য প্রথম গান ‘আমার গানেতে এল নবরূপী চিরন্তন’ রেকর্ড করেন হেমন্ত। কিন্তু গানটি সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৭ সাল থেকে তিনি পুরোপুরি প্রবেশ করেন সঙ্গীত জগতে। এই বছর তিনি নরেশ ভট্টাচার্যের কথা এবং শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে গ্রামোফোন কোম্পানী কলম্বিয়ার জন্য ‘জানিতে যদিগো তুমি’ এবং ‘বলো গো তুমি মোরে’ গান দুটি রেকর্ড করেন। বাল্যবন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাকে গান গাইবার জন্য ইডেন গার্ডেনের স্টুডিওতেও নিয়ে গিয়েছিলেন একবার। এরপর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই তিনি ‘গ্রামোফোন কোম্পানী অফ ইন্ডিয়া’র জন্য গান রেকর্ড করেছেন। ১৯৪০ সালে, সঙ্গীত পরিচালক কমল দাসগুপ্ত, হেমন্তকে দিয়ে, ফৈয়াজ হাসমির কথায় “কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে” ও “ও প্রীত নিভানেভালি” গাওয়ালেন।
১৯৪১ সালে শিল্পী প্রথম প্লেব্যাক করেন “নিমাই সন্ন্যাস” ছবিতে। এরপর থেকেই তিনি ভারতীয় বাংলা সিনেমার একজন অপরিহার্য শিল্পী হিসেবে পরিগণিত হন। ১৯৪৪ সালে ‘ইরাদা’ ছবিতে প্লে-ব্যাক করে হিন্দী গানের শ্রোতাদেরকেও নিজের জাত চিনিয়েছিলেন হেমন্ত। একই বছরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম নিজের কম্পোজিশনে দুটো গান করেন। গান দুটির গীতিকার ছিলেন অমিয় বাগচী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের করেছিলেন। তবে তিনি প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন ১৯৪৪ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী’ সিনেমাতে। এছাড়াও কলম্বিয়ার লেবেলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের করেছিলেন তিনি। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ১৯৪৭ সালে ‘অভিযাত্রী’ সিনেমার মাধ্যমে।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই হেমন্ত সম্ভাবনাময় শিল্পী এবং কম্পোজার হিসেবে সবার নজর কাড়েন। সেসময় তিনিই ছিলেন একমাত্র পুরুষ কণ্ঠশিল্পী যিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কাজ করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে হিন্দি সিনেমা ‘নাগিন’ এর সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। এই ছবির গান সেসময় দুই বছর ধরে টপচার্টের শীর্ষে অবস্থান করেছিল এবং এই সিনেমার জন্যই হেমন্ত ১৯৫৫ সালে ‘ফিল্মফেয়ার বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর’ এর পুরস্কার লাভ করেন। এরপর তিনি বাংলা সিনেমা ‘শাপমোচন’ এর সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই ছবিতে তিনি উত্তম কুমারের জন্য চারটি গান করেছিলেন। তারপর থেকেই যেন উত্তম কুমারের ছবি মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। পরবর্তী সময়ে এই জুটি পেয়েছিল আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।
‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে, আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে’ মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ঢাকায় এসে এই গানটি শুনিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
অবশেষে ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতায় ইন্দ্রপতন। সুরের হেমন্ত- আকাশ আঁধারে মলিন হলো।
শরতে চলে গিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কান পাতলেই আজও কিন্তু তিনি আছেন।
পরাগ ঝরানো স্বপ্ন ভরানো বনে
ভ্রমর যেথায় সুর তোলে মনে মনে
আমার এ গান খুঁজো তুমি তারই মীড়ে
আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোনো
আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে
তবু আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে …।
( কৃতজ্ঞতা – তথ্য সংগ্রহে আন্তর্জাল)
Be First to Comment