ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায়: কলকাতা, ২৪ মে, ২০২৫। যতটা না ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান তার চেয়ে অনেক বেশী বাঙালী জীবনের আন্তরিক হৃদ্যতার বহিঃপ্রকাশ ৷ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ও ধর্মচিন্তার প্রকাশ দেখা যায় “জামাই ষষ্ঠী” ব্রতে ৷ আদিম সমাজের বৃক্ষ তথা প্রকৃতি পুজোর নিদর্শনও মেলে ৷ তাই , অশ্বথ্থ ও বট গাছতলায় ষষ্ঠী পুজো হয় ৷ হিন্দু সমাজের এমন অনেক লৌকিক আচার নিয়ে আমার “সনাতনী কৃষ্টিকথা ” ও হিন্দু ধর্ম বইদুটিতে বিস্তারিত লিখেছি ৷ জামাইষষ্ঠীর দিনে শ্বাশুড়িরা স্নান করে গাছতলায় বা ষষ্ঠী মন্দিরে বা বাড়ীতে নানা উপাচার ও দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় পুজো দেন ৷ এর সঙ্গে প্রচলিত গ্রামের এক ব্রাহ্মণী ,তাঁর তিন ছেলে- বৌমা – বিড়ালের গল্প ৷ লোভে বাড়ীর ছোট বৌটি চুরি করে মাছ খেয়ে বলে বিড়ালে খেয়েছে ৷ ষষ্ঠীর বাহন বিড়াল ৷ তাই ষষ্ঠী দেবী কূপিত হন ৷ তার সন্তান হারিয়ে যায় ৷ হয়ত তাই পঞ্চম শতকের কাশ্যপ সংহিতায় ষষ্ঠীকে বলা হয়েছে “জাতহরণী” ৷ যিনি মাতৃগর্ভ থেকে ভ্রূণ হরণ করেন ৷ তাই , শিশু জন্মের ছ’দিন পরে ষষ্ঠী পূজার প্রচলন হয় ৷ যাহোক চুরি করে মাছ খাওয়া বৌটি পরে সন্তান দাত্রী ও সন্তানের রক্ষাকত্রী দেবী ষষ্ঠীর আরাধনা করে সব ফিরে পান ৷ বৌ এরপর বাবা-মা জামাই -মেয়েকে বাপের বাড়ীতে ডেকে ষষ্ঠী পুজোর আয়োজন করে ৷ এই লোকায়ত প্রথা বা ব্রতটি “জামাই ষষ্ঠী ” ৷ অনেকে মনে করেন জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীর অর্থাৎ সাবিত্রী চতুর্দশীতে বৌরা বরের কল্যাণে যমের পুজো করেন ৷ সে থেকেও জামাইকে আদর ,যত্ন করে শ্বশুর বাড়ীতে ডেকে জামাই ষষ্ঠীর প্রচলন হয়ে থাকতে পারে ৷ জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী তিথির প্রথম প্রহরে এই অনুষ্ঠান হয় ৷ এটা প্রাচীনতর কৌম্যজীবনের বা আদিম অরণ্য জীবনের প্রতিভাস হলেও প্রসাদ, ফুল-তেল-সিঁদুরের চেয়ে জামাইয়ের পেট পুজো বড় হয়ে ওঠে ৷
” জামাই ষষ্ঠীর মন্ত্র “!
” জয় দেবী জগন্মাতা জগদানন্দকারিণী
প্রসীদ মম কল্যাণী ষষ্ঠী দেবী নমোহস্তুতে ” ৷
আমাদের হিন্দু ধর্মে বিবাহ শুধু একটি পুরুষ ও মহিলার চুক্তি নয় একটি পরিবারের সাথে আরেকটি পরিবারের বন্ধন ৷ একসময় প্রসূতি ও শিশু মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশী ৷ তাই , সন্তানের মঙ্গল কামনায় মায়েরা অনেক গুলি ষষ্ঠী পুজো ও ব্রত পালন করতেন ৷ এখনও করেন ৷ জামাই পুত্র তুল্য ( Son in law) ,তাই মধুমাস জ্যৈষ্ঠের শুক্লা ষষ্ঠীতে শ্বাশুড়িরা উপবাসে থেকে জামাইয়ের হিত কামনায় অশ্বথ্বততলা বা ষষ্ঠী মন্দিরে পুজো দিয়ে
ধান – দূর্বা দিয়ে আর্শীবাদ করেন ৷ “ধান” সম্পদ ও
বহু সন্তানের এবং দূর্বা অমরত্ব ও চির যৌবনের প্রতীক ৷ শ্বাশুড়ি এদিন মেয়ে ও পুত্রসম জামাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে ধানদূর্বা দিয়ে আর্শীবাদ করেন ও উলুধ্বনিসহ জামাতাকে বরণ করেন ৷তালপাতার পাখার বাতাস করে “ষাট -ষাট- ষাট” বলার মানে জামাই -মেয়ের সব বিপদ -আপদ দূরের কামনা এবং দীর্ঘায়ুর প্রার্থনা ৷ জামাইয়ের হাতের বাজুবন্ধে তেল – হলুদ মাখা পুজোয় উৎসর্গ করা ডোর বা সুতো বাঁধা হয় ৷ ফুল , বেল পাতা দিয়ে সুতো বেঁধে দেওয়ার মানে দুই পরিবারের তথা জামাই -মেয়ের সুদৃঢ় বন্ধন কামনা ৷ অনেক জায়গায় দূর্বা-বাঁশের কড়ুল , ধান ফুল , করমচা দিয়ে “মুঠা” বেঁধে জামাইয়ের মাথায় ছোঁয়ানো হয় ৷ আবার কোথাও সাদা সুতোয় ৫-৭ পাক দিয়ে ফুল -বেলপাতা বেঁধে হলুদ মাখিয়ে জামাইয়ের মাথায় ঠেকানো হয় ৷ জামাইয়ের সাথে নাতি নাতনিরাও পেট পুরে খেয়ে মামার বাড়ীর সবার সাথে আনন্দ করে ৷ মধু মাস জ্যৈষ্ঠে পাওয়া যায় আম , কাঁঠাল , জাম , জামরুল , সবেদা , মেঠো খেজুর , তাল , কামরাঙা , কুসুম , গাব , কেন্দু , ডেলো , ফলসা , আঁশফলের মত বাংলার দেশজ ফল ৷ যা ষষ্ঠীর পুজো ও প্রসাদে থাকে ৷ একটা সময় সমগ্র ভারতবর্ষে সংস্কার ছিল কন্যা পুত্রবতী না হওয়া পর্যন্ত বাবা -মা মেয়ের বাড়ী না যাওয়ার ৷ জামাই ষষ্ঠী বা অরণ্যষষ্ঠী বা বাঁটা ষষ্ঠী বা স্কন্দ ষষ্ঠী পিতা-মাতাকে কন্যা ও জামাতাকে দেখার সুযোগ করে দেয় ৷ প্রতিমা , ঘট বা ছবি এঁকে করা হয় ষষ্ঠী দেবীর আরাধনা ৷ ষষ্ঠী তলায় মেয়েরা একে অপরের কল্যাণ কামনার সঙ্গে মেয়ে বেলার বান্ধবী ও তাদের বরেদের নিয়ে মেতে ওঠে হুল্লোড়ে৷ আগে সিনেমা দেখা , খেলা এসব নিয়ে জমজমাট থাকতো সারাটা দিন ৷ প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্রটিও ছিল “জামাই ষষ্ঠী” !
বাঙালি হিন্দু নারীর বিবাহপূর্বে আরাধ্য দেবতা শিব , বিয়ের পর বাকী জীবন মা লক্ষ্মী , একজন মা হিসাবে সন্তানের মঙ্গল কামনায় ষষ্ঠীর , পুত্রের আয় উন্নতির জন্য গণেশের এবং সংসারের মঙ্গলের জন্য বিপত্তারিণীর কৃপা কামনা করেন ৷ জামাইষষ্ঠীতে হয়েছে শ্বশুরবাড়ীর সবাইকে নিয়ে মাতামাতি ও উপহার বিনিময় ৷ আসলে এ যে বাঙালি জীবনের অন্তরের উৎসব তথা হৃদয়ের বন্ধন ৷ ” ক্ষণরূপা ক্ষণে দেবী ক্ষণে নিশাচরী ,
ক্ষণেতে ভৈরবী হন ক্ষণেতে কুমারী “৷ ষষ্ঠী আসলে , দেবী ষষ্ঠীরূপে স্বয়ং ভগবান নারায়ণ বলেও বলা হয়েছে -” জয় জয় বন্দ মা ষষ্ঠীর চরণ / আপনি ষষ্ঠীরূপ ধরেন নারায়ণ ” ৷জয় মা ষষ্ঠী ! ষষ্ঠী দ্বিভূজা , বরাভয়দায়িনী , গৌরী , নিত্যা , সন্তানপ্রদা ,দিব্যবাসনা সর্বলক্ষণ সম্পন্না ৷ ষষ্ঠীর বাঁ কোলে পুত্র থাকে ৷ যা মাতৃত্বের পরিচয় ৷ জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষের সাবিত্রী চতুর্দশী তিথিতে স্ত্রীরা যেমন স্বামীদের দীর্ঘায়ু কামনা করে যমের আরাধনা করেন ৷ জামাই ষষ্ঠীতে জামাতার মঙ্গল কামনায় তেমন শ্বাশুড়িদের জামাই ষষ্ঠী ৷ভাই ফোঁটা , রাখী বন্ধনের
মত এই পরবও বাঙালি জীবনে স্থায়ী হোক ৷
জামাই ষষ্ঠী বাঙালী হিন্দুদের পূজা ও ব্রত ৷আদি প্রকৃতির ষষ্ঠাঙ্গ অংশভূতা বলে তাঁর নাম “ষষ্ঠী” ৷ বায়ুপুরাণে ৪৯টি দেবীর অন্যতমা ষষ্ঠী ৷ আবার কোথাও ষষ্ঠীকে “সব মাতৃদেবীর মধ্যে আরাধ্যাতমা ” বলা হয়েছে ৷ যাজ্ঞবাল্ক্য স্মৃতিতে তিনি স্কন্দদেবের রক্ষয়িত্রী তথা পালিকা মা ৷ তাঁর আরো নাম কৌমারী , দেবসেনা , বালি , স্কন্দ জায়া ৷ যাঁর বাহন বিড়াল মনে করা হয় বিড়ালের দুধ নাকি অনেক রকম স্ত্রী রোগ ভালো করে ৷ আবার বিড়ালকে প্রজনন শক্তির প্রতীক মনে করা হয় ৷হয়তো তাই বিড়াল এই দেবীর বাহন হয়েছে ৷ বারো মাসে ভিন্ন ভিন্ন ষষ্ঠী পূজা প্রচলিত ৷সারা ভারতে নানাভাবে চালু ৷বিহারে বলা হয় ছ’ঠী মাইয়া ৷ওড়িশায় সন্তান জন্মের ৬ এব২১-তম দিনে ষষ্ঠী পূজা হয় ৷বালেশ্বরে সুপ্রাচীন ষষ্ঠী মূর্তি পাওয়া গেছে৷ উত্তরপূর্ব কলকাতার ষষ্ঠীতলায় ষষ্ঠী মায়ের মন্দির আছে। উত্তরভারতের অনেক জায়গায় বিয়ের সময় ষষ্ঠী পুজো হয় ৷ দেবী ভাগবত পুরাণের নবম স্কন্দে বলা হয়েছে ,” ষষ্ঠাংশা প্রকৃতের্যে চ সা চ ষষ্ঠী প্রকীর্তিতা / বালকানামধিষ্ঠাত্রী বিষ্ণুমায়া বালদা “৷ মহাভারতের সভা পর্বে ব্রহ্মার সভায় বিরাজিতা ষষ্ঠীর নাম করা হয়েছে ৷ হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতাতেও এমন শিশুর রক্ষয়িত্রী দেবী মূর্তির আরাধনা প্রচলিত ছিল ৷ বৌদ্ধ দেবী হারিতীর সাথেও ষষ্ঠীর মিল চোখে পড়ে ৷জৈন দেবী নৈগমেসাও শিশু কল্যাণকারী ৷ পশ্চিম রাঢ়ে “বুড়ি” নামের খুনিয়া বুড়ি , ভাঁড়রা বুড়ি , ঘাঘরবুড়ির সাথেও ষষ্ঠীর মিল দেখা যায় ৷ কবি কৃষ্ণরামের “ষষ্ঠী মঙ্গল ” এ মা ষষ্ঠী পুজো প্রচারের কথা আছে ৷ এখনও ওড়িশা ও মেদিনীপুরে ষষ্ঠীর পালাগান হয় ৷আদিমকালের মত আজও স্রেফ আঙুল টিপে বাঁকুড়ায় ষষ্ঠীপুতুল তৈরী হয় ৷ মহাষষ্ঠীর সকালে হয় মা দুর্গার সংকল্প ৷ বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের যুগে বৈধ্যবের যন্ত্রণার শিকার ছিল মেয়েরা ৷ সে জন্য হয়তো জামাইয়ের মঙ্গল কামনা শ্বাশুড়িদের কাছে বেশী গুরুত্ব পেয়েছিল ৷ জন মারডক ও সি এইচ বাক প্রাচীন ইউরোপেও এমন লোকাচার ছিল বলে লিখেছেন ৷ কিন্তু , জামাই ষষ্ঠীর কথা মনে এলেই সব জামাইয়ের আমারই মত প্রথম মনে পড়ে নিজের শ্বাশুড়িমাকে ৷ ক’দিন পরে জামাইষষ্ঠী জামাইরা এবারেও আনন্দে মেতে উঠুন ৷ তাদের জন্য আমার আগাম শুভকামনা ৷
ওঁ হ্রীঁ ষষ্ঠীদেব্যৈয় স্বাহা ৷
ছবি – কৃতজ্ঞতা স্বীকার :- গুগল।
মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ও ধর্মচিন্তার প্রকাশ দেখা যায় জামাই ষষ্ঠী ব্রতে….।

More from BooksMore posts in Books »
- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে শ্রর্দ্ধাঘ্য….।
- “Load the Box” Book Fair – book fair Returns of Acropolis Mall to delight book enthusiasts….
- এমনও তো হতে পারে কোনো এক জন্মে আমিই ছিলাম তোমার ঘরে মৃণালিনীর বেশে….।
- হিন্দু নারীর সিঁদুর মুছিয়ে গর্বের ব্যঙ্গ উক্তি, “বলগে প্রধানমন্ত্রীকে তোরা বুঝুক জঙ্গি শক্তি”….!
- কল্যাণীতে বিশ্বমানের আলোচনাসভায় সত্যজিৎ রায়….।
- Highlights from the inauguration of Boiparay Boi Utsab…..
More from InternationalMore posts in International »
- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে শ্রর্দ্ধাঘ্য….।
- শিল্পী চক্রবর্তীর কাহিনী ও পরিচালনায় সামাজিক বার্তা নিয়ে নির্মিত স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ‘দায়ী কে’?
- TV9 বাংলার নতুন নিউজ সিরিজ ‘ঘরের শত্রু’ ……।
- পাঁশকুড়ায় চুরির অপবাদেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা ক্লাস সেভেনের পড়ুয়ার….।
- আলোঝলমল ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রনে সেজে উঠল কলকাতার ৩ নম্বর গভর্নমেন্ট প্লেস এর শতাব্দী প্রাচীন আয়কর ভবন….।
- মহারাজা কাশিমবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীদের জন্য নতুন কম্পিউটার ল্যাব….।
More from SocialMore posts in Social »
- পাঁশকুড়ায় চুরির অপবাদেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা ক্লাস সেভেনের পড়ুয়ার….।
- উৎকর্ষে আরোহণ ও সন্তোষপুর আদি সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি সুন্দরবনের পিছিয়ে পড়া মানুষদের পাশে দাঁড়ালো….।
- পূর্ব বর্ধমানের ক্ষীরগ্রামের মা যোগাদ্যা….।
- Acropolis Mall Celebrates the Magic of Motherhood – This Mother’s Day….
- শ্যাম সুন্দর কোং জুয়েলার্স উপস্থাপন করেছে… ‘শ্রীচরনেষু মা’!…..
- আসানসোলে বুম্বা মুখার্জীর জন্মদিনে মানবিক উদ্যোগ নিল অল ইন্ডিয়া হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন….।
Be First to Comment