ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫। ” অহং পূর্ণো ভবিষ্যামি যুগো সন্ধৌ বিশেষতঃ ৷
মায়াপুরে নবদ্বীপে ভবিষ্যামি শচীসূতঃ ( গরুড় পুরাণ ) আবার পদ্মপুরাণে শ্রীচৈতন্যর আগমনী –
” কলৌ প্রথম সন্ধ্যায়াং গৌরাঙ্গহহং মহীতলে ৷
ভাগীরথীতটে ভূম্নি ভবিষ্যামি সনাতনঃ ৷” কপিলতন্ত্রে – ” জম্বুদ্বীপে কলৌ ঘোরে মায়াপুরে
দ্বিজালয়ে ৷/ জনিত্বা পার্ষদৈঃ সাদ্ধংকীতনং কারয়িষ্যতি ৷ তখন আজকের মত ১৮ ফেব্রুয়ারী কলির অবতার শ্রীচৈতন্যদেব ধরাধামে আসেন ৷
যখন অধর্মে পৃথিবী ছেয়ে যায় তখন ভগবান চিন্ময় জগত থেকে আমাদের শিক্ষা দিতে স্বেচ্ছায় মর্ত্যে অবতরন করেন ৷ তাঁদের মধ্যে দেখতে পাই মনুষ্যত্বের চরম প্রকাশ ৷ মানুষের মাঝে মানুষের বেশে যুগে যুগে তিনি আসেন ৷ আমরা বিষ্ণু , শিব, শক্তি ও গণেশের অবতারের কথা মানি ৷ আমরা
সনাতনীরা মনে করি প্রাণীমাত্রই প্রথমে অব্যক্ত ( অপ্রকাশিত / নিরাকার) , মাঝে ব্যক্ত (প্রকাশিত) এবং শেষে আবার অব্যক্ত ( অপ্রকাশিত) হয়ে যায়৷ ভগবানের যেমন দুই রূপ – নিরাকার ও সাকার ৷ যেমন জল পরমাণু রূপে নিরাকার ৷ কিন্তু , মেঘ ও বৃষ্টি রূপে সাকার ৷ তিনিই একমাত্র অবতার যিনি কোন অসুর বধের জন্য এ জগতে আসেন নি ৷
এসেছেন আমাদের মত অধম – পতিত- পাপীদের
উদ্ধার করতে ৷তাঁর অস্ত্র “হরিনাম মহামন্ত্র “! তিনি কলির সার ১৬ শব্দ ও ৩২ অক্ষরের ” হরে কৃষ্ণ হরে রাম ” মহামন্ত্র জগত বাসীর জন্য বিলিয়ে গেছেন ৷ ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের
১৮ ফেব্রুয়ারি ( ১৪০৭ শকাব্দে) ফাল্গুনি পূর্ণিমার দিন নবদ্বীপের শ্রীমায়াপুরে এক নিম গাছ তলায় জন্মগ্রহণ করেন
জগন্নাথ দাস বাবাজী ঔ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর এই জন্মস্থান নির্ধারন করে বিশ্ববাসীকে ভগবানকে বন্দনার সুযোগ করে দিয়েছেন ৷
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব যে ভগবানের অবতার বিভিন্ন গ্রন্থ বহু আগেই তা বলে গেছেন ৷ অর্থববেদে ব্রহ্ম মহর্ষি পিপ্পিলাদকে বলেছেন -” জাহ্নবী তীরে নবদ্বীপে গোলোকাখ্যে ধান্নি গোবিন্দো দ্বিভুজো গৌরঃ সর্বাত্মা মহাপুরুষো মহাত্মা মহাযোগী ত্রিগুণাতীতঃ সত্বরূপো ভক্তিং লোকে কাশ্যতীতি ” ( সবার আত্মস্বরূপ মহাপুরুষ পরমাত্মাস্বরূপ মহাযোগী , ত্রিগুণাতীত , বিশুদ্ধ সত্বময় দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর স্বয়ং জাহ্নবীতীরে গোলোকাখ্য নবদ্বীপ ধামে শ্রীগৌরসুন্দর রূপে অবর্তীণ হয়ে জগতে ভক্তিপ্রকাশ করবেন ৷) ৷
মৎস্যপুরাণে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন ,” আমি কলিযুগে গঙ্গাতটে সুদীর্ঘ গৌরাঙ্গরূপে প্রকটিত হয়ে জগতের প্রতি করুণাবশত মুন্ডিত মস্তক সন্ন্যাসী বেশে সকলকে যুগধর্ম হরিনাম সংকীর্তন করাব ৷
( মুন্ডো গৌরঃ সুদীর্ঘ মিস্ত্রি স্রোতস্তীর সম্ভবঃ ৷
দয়ালু কীর্তনগ্রাহী ভবিষ্যামি কলৌযুগে ৷৷) ৷
মার্কন্ডেয় পুরাণে আছে -” গোলোকং চ পরিত্যক্তা
লোকনাং ত্রনিকারনাৎ ,/ কলৌ গৌরাঙ্গরূপেন লীলালাবণ্য বিগ্রহ ৷৷”
মহাভারতে কলিযুগে গৌরাঙ্গ অবতারের ভবিষ্যদ বাণী রয়েছে ৷-” সুবর্ণবর্ণো হৈমাঙ্গ বরাদ্দশানন্দ নাঙ্গদী ৷/ সন্ন্যাস কৃচ্ছ্রমঃ শান্তো নিধাশান্তি পরায়ণ”
গদাধর পন্ডিতের সামনে নিজের চোখের জলে বিশ্বম্ভর ( নিমাই) এর পা ধুয়ে দিয়ে তাঁকে ( চৈতন্যদেব) অবতার হিসাবে ঘোষণা করেন ৷
নিত্যানন্দকে বলেন বলরামের অবতার ৷শ্রীবাস আচার্য ও মাধবেন্দ্র পুরী চিনেছিলেন নিমাইকে !
শ্রী গৌর হরির পিতা জগন্নাথ মিশ্র ও মাতা শচী দেবী। জগন্নাথ মিশ্রের পরপর আট কন্যা হয়। কিন্তু কেহই জীবিত ছিলনা। তার পরে এক পুত্র হয়। নাম তার বিশ্বরূপ। ছেলের বয়স যখন আট বছর তখন জগন্নাথ মিশ্রের বাবা-মায়ের নিকট হতে একটা চিঠি আসে ৷ তাতে লেখাছিল তাড়াতাড়ি যেন স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সিলেট তাঁদের কাছে আসেন। পিতার মাতার এই আজ্ঞা পেয়ে শচী দেবী ও জগন্নাথ মিশ্র শ্রীহট্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং কিছুদিন পর নিজ গৃহে মাতা-পিতার নিকট পৌছান।
১৪০৬ শতাব্দের মাঘ মাসে শচী দেবী আবার গর্ভবতী হলেন। শোভা দেবী (শাশুড়ীমাতা) রাত্রিতে স্বপ্ন দেখেন যে, কোন মহাপুরুষ তাঁকে বলছেন যে, পুত্রবধুর গর্ভে স্বয়ং ভগবান প্রবেশ করেছেন এবং তাই ,শচীদেবীকে নবদ্বীপ পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য বলেন। এইজন্য জগন্নাথকে শচীদেবীসহ নবদ্বীপে নিয়ে যাওয়ার জন্য শোভা দেবী আদেশ করলেন। জগন্নাথ মিশ্র মশাই শচীদেবীকে নিয়ে নবদ্বীপের বাড়ীতে এলেন। শচীর দেবীর গর্ভ দশমাস উত্তীর্ণ হল তবু পুত্র কন্যা কিছুই হল না। ক্রমে একাদশমাস, দ্বাদশ মাস উত্তীর্ণ হল তবুও সন্তানের জন্ম হল না। ১৪০৭ শতাব্দের ফাল্গুন মাস আসল জগন্নাথ মিশ্র ব্যস্ত হয়ে শ্বশুর নীলাম্বর চক্রবর্তীকে ডাকলেন। নীলাম্বর পন্ডিত গননা করে বললেন অতি সত্বর শচীর সন্তান হবে। তার গর্ভে কোন এক মহাপুরুষ জন্ম নেবেন। একথা শুনে সকলে আস্বস্ত হলেন ৷ এরপর –
চৌদ্দশত সাত শকে মাস যে ফাল্গুন
পৌর্নমাসী সন্ধ্যাকালে হৈল শুভক্ষণ,
সিংহ রাশী, সিংহ লগ্ন উচ্চ প্রহসন
ষড়বর্গ অষ্টবর্গ সবর্ব শুভক্ষণ।
অর্থাৎ ১৪০৭ শতাব্দে জাহ্নবী( গঙ্গা) তীরের নবদ্বীপ নগরে। মনোরম ফাল্গুন মাসে, নির্মল পূর্ণিমা সন্ধ্যায় শ্রী গৌরাঙ্গদেব অবতীর্ণ হলেন। তখন পূর্ণিমার সন্ধ্যায় পূর্বদিকে একখানা উজ্জ্বল থালার মত চাঁদ উঠলো । সিংহ রাশিতে পূবর্বফাল্গুনী নক্ষত্রে মাতৃগর্ভ হতে গৌরাঙ্গ অবির্ভূত হলেন। নবদ্বীপবাসী প্রফুল্ল মনে হরিধ্বনি করে শিশুকে স্বাগত জানালেন ৷
সে সময় নবদ্বীপ বুদ্ধিমান ও নৈয়ায়িক পন্ডিত দ্বারা পূর্ণছিল। যাতে ছিল অহংবোধ ছিল না ভক্তির লেশ ৷ এই কঠিন সময়ে শ্রী গৌরহরি ভক্তিরস বিতরণের জন্য নদীয়ায় অবর্তীর্ণ হলেন।
যাঁর আগমন বার্তা অনেক প্রাচীন গ্রন্থে রয়েছে ৷
কলোহ প্রথম সন্ধ্যায়ং গৌরাঙ্গ অহর মহীতটে।
ভাগীরথী তটে ভূবী ভবিষ্যামী সনাতন। —-ব্রহ্ম পূরাণ
অর্থাৎ কলির প্রথম সন্ধ্যায় গৌরাঙ্গরূপে এই ধরাতলে ভগীরথী তীরে আবির্ভূত হব।
চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি দোলপূর্ণিমার রাত্রে চন্দ্রগ্রহণের সময় নদিয়ার মায়াপুরে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম। তাঁর পিতামাতা ছিলেন অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত নবদ্বীপের অধিবাসী জগন্নাথ মিশ্র ও শচী দেবী। চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ওড়িশার জাজপুরের আদি বাসিন্দা। তাঁর পিতামহ মধুকর মিশ্র ওড়িশা থেকে শ্রীহট্ট বা সিলেট জেলার ঢাকা দক্ষিণ গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তারপর আসেন তৎকালীন বাংলা
সংস্কৃতি ও তথা ধর্মের মূল কেন্দ্র নবদ্বীপে ৷
চৈতন্যদেবের পিতৃদত্ত নাম ছিল বিশ্বম্ভর মিশ্র। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন স্বনামধন্য পণ্ডিত।
ছেলে বেলায় তিনি ভীষন দুষ্টু ছিলেন ৷এরপর তর্কশাস্ত্রে নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিতের খ্যাতি অর্জন করেন । জপ ও কৃষ্ণের নাম কীর্তনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ যে ছেলেবেলা থেকেই বজায় ছিল, তা জানা যায় তাঁর জীবনের নানা কাহিনী থেকে। কিন্তু তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিল সংস্কৃত গ্রন্থাদি পাঠ ও জ্ঞানার্জন। পিতার মৃত্যুর পর গয়ায় পিণ্ডদান করতে গিয়ে নিমাই তাঁর গুরু ঈশ্বর পুরীর সাক্ষাৎ পান। ঈশ্বর পুরীর নিকট তিনি গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত হন। এই ঘটনা নিমাইয়ের পরবর্তী জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। বাংলায় ফেরার পর পণ্ডিত থেকে ভক্ত হিসাবে তাঁর মনের অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন দেখে অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় বৈষ্ণব সমাজ আশ্চর্য হয়ে যান।
এভাবে নিমাই নদিয়ার বৈষ্ণব সমাজের এক অগ্রণী নেতায় পরিণত হন।
কাটোয়ায় কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষা নেওয়ার পর নিমাই ‘শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ নাম গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর প্রথমে সমগ্র রাঢ় বাংলা এবং অনতিবিলম্বে তিনি জন্মভূমি বাংলা ত্যাগ করে কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান পর্যটন করেন। এই সময় তিনি অবিরত কৃষ্ণনাম জপ করতেন। জীবনের শেষ চব্বিশ বছর তিনি অতিবাহিত করেন জগন্নাথধাম পুরীতে। উড়িষ্যার সূর্যবংশীয় সম্রাট গজপতি মহারাজা প্রতাপরুদ্র দেব চৈতন্যমহাপ্রভুকে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ অবতার মনে করতেন। মহারাজা প্রতাপরুদ্র চৈতন্যদেব ও তাঁর সংকীর্তন দলের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিলেন। জীবনের শেষপর্বে চৈতন্যদেব ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতেন এবং অধিকাংশ সময়েই ভাবসমাধিস্থ থাকতেন।
অধিকাংশ সময় জগন্নাথ মন্দিরে কাটাতেন ৷
তিনি শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণাবতার বলে গৌড়ীয় ও উৎকল বৈষ্ণব সমাজে স্বীকৃতি পান । শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য ছিলেন ভাগবত পুরাণ ও ভগবদ্গীতা-য় উল্লিখিত দর্শনের ভিত্তিতে সৃষ্ট বৈষ্ণব ভক্তিযোগ মতবাদের একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা। তিনি বিশেষত রাধা ও কৃষ্ণ রূপে ঈশ্বরের পূজা প্রচার করেন এবং হরে কৃষ্ণমহামন্ত্রটি জনপ্রিয় করে তোলেন। সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষাষ্টক নামক প্রসিদ্ধ স্তোত্রটিও তাঁরই রচনা। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতানুসারে, ভাগবত পুরাণের শেষের দিকের শ্লোকগুলিতে রাধারানির ভাবকান্তি সংবলিত শ্রীকৃষ্ণের চৈতন্য রূপে অবতার গ্রহণের কথা বর্ণিত হয়েছে।
ছান্দসিক কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন ,
” বাঙালীর হিয়া – অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া ” ! আসলে চৈতন্যচন্দ্রদয় ঠিক বলেছে ” আদি পুরুষ , সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য শরীর ধারন করে কৃপার সাগর হয়ে মানব কল্যাণে অবর্তীন হয়েছিলেন “৷ ( বৈরাগ্য বিদ্যা নিজ ভক্তি যোগ শিক্ষার্থমেকঃ পুরুষঃ পুরাণঃ /
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যশরীরধারী কৃপাম্বুধির্যস্তমহং প্রপদ্যে ৷)
মহাপ্রভু বলেছিলেন বিনয় ও ভক্তির সঙ্গে নাম গান মুক্তির উপায় ৷ ” হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম / কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা ” ৷
আজ সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়েছে “হরি নাম “৷
“হর্ষে প্রভু কহে শুন স্বরূপ রামরায় ৷
নাম- সংকীর্তন কলৌ পরম উপায় ৷” মধুমাখা এই হরিনাম আমাদের মুক্তি দিক ৷
চৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্বাশ্রমের নাম গৌরাঙ্গ ও নিমাই। তাঁর গাত্রবর্ণ স্বর্ণালি আভাযুক্ত ছিল বলে তাঁকে গৌরাঙ্গ বা গৌর নামে অভিহিত করা হত। অন্যদিকে নিম বৃক্ষের নিচে জন্ম বলে তাঁর নামকরণ হয়েছিল নিমাই। ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী সাহিত্য বাংলা সন্তজীবনী ধারায় এক নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছিল। বাংলা সাহিত্য এক উল্লেখযোগ্য মোড় নেয় ৷ সেযুগে একাধিক কবি চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী অবলম্বনে
“ভাগবত , ভারত শাস্ত্র আগম পুরাণ ৷
চৈতন্য কৃষ্ণ – অবতার প্রকট প্রমাণ ( চৈঃচঃ)
” বন্দেহনন্তাদ্ভূতৈশ্বর্য্যাং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুম্ ৷
নীচোহপি যৎ প্রসাদৎ ভক্তিশাস্ত্র প্রবর্তক ৷৷”
“কলি যুগে সপার্ষদ শ্রীরাম / শ্রীকৃষ্ণ “!
” নন্দসুত বলি যারে ভাগবতে গাই ৷
সেই কৃষ্ণ অবতীর্ণ চৈতন্য গোঁসাই ৷৷”
” ত্রেতাযুগে রক্তবর্ণ পৃশ্নিগর্ভ নাম ৷
দ্বাপরে বরণ শ্যাম নাম হয় ‘ শ্যাম’ ৷৷
কলিযুগে কৃষ্ণবর্ণ কল্কি অবতার ৷
পূর্ব কলিযুগে চাসপক্ষ কর্ণধর ৷৷”
কলির অবতার শ্রীচৈতন্যদেব !
যখন অধর্মে পৃথিবী ছেয়ে যায় তখন ভগবান চিন্ময় জগত থেকে আমাদের শিক্ষা দিতে স্বেচ্ছায়
ভক্তের ভালোবাসার টানে মর্ত্যে অবতরন করেন ৷ তাই অবতার ৷নরলীলার অবতার ৷ তাঁদের মধ্যে দেখতে পাই মনুষ্যত্বের চরম প্রকাশ ৷ মানুষের মাঝে মানুষের বেশে যুগে যুগে তিনি আসেন ৷ যাতে ভগবানকে ভক্তরা সহজে বাবা , মা , ভাই , বোন কিংবা সন্তানের মত দেখতে পারে ৷ আমরা বিষ্ণু , শিব,
শক্তি ও গণেশের অবতারের কথা মানি ৷ আমরা
সনাতনীরা মনে করি প্রাণীমাত্রই প্রথমে অব্যক্ত ( অপ্রকাশিত / নিরাকার) , মাঝে ব্যক্ত (প্রকাশিত) এবং শেষে আবার অব্যক্ত ( অপ্রকাশিত) হয়ে যায়৷ ভগবানের যেমন দুই রূপ – নিরাকার ও সাকার ৷ যেমন জল পরমাণু রূপে নিরাকার ৷ কিন্তু , মেঘ ও বৃষ্টি রূপে সাকার ৷ ঈশ্বর সত্য আর সব অনিত্য ৷ তিনি বাজিকর আর সব বাজিকরের ভেলকি ৷
লোচন দাস বলেছেন !” শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সব অবতারের সার “৷ তিনিই একমাত্র অবতার যিনি কোন অসুর বধের জন্য এ জগতে আসেন নি ৷
এসেছেন আমাদের মত অধম – পতিত- পাপীদের
উদ্ধার করতে ৷তাঁর অস্ত্র “হরিনাম মহামন্ত্র “! তিনি কলির সার ১৬ শব্দ ও ৩২
অক্ষরের ” হরে কৃষ্ণ হরে রাম ” মহামন্ত্র জগত বাসীর জন্য বিলিয়ে গেছেন ৷ ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের
১৮ ফেব্রুয়ারি ( ১৪০৭ শকাব্দে) ফাল্গুনি পূর্ণিমার দিন নবদ্বীপের শ্রীমায়াপুরে এক নিম গাছ তলায় জন্মগ্রহণ করেন
জগন্নাথ দাস বাবাজী ঔ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর এই জন্মস্থান নির্ধারন করে বিশ্ববাসীকে ভগবানকে বন্দনার সুযোগ করে দিয়েছেন ৷
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব যে ভগবানের অবতার বিভিন্ন গ্রন্থ বহু আগেই তা বলে গেছেন ৷ অর্থববেদে ব্রহ্ম মহর্ষি পিপ্পিলাদকে বলেছেন –
” জাহ্নবী তীরে নবদ্বীপে গোলোকাখ্যে ধান্নি গোবিন্দো দ্বিভুজো গৌরঃ সর্বাত্মা মহাপুরুষো মহাত্মা মহাযোগী ত্রিগুণাতীতঃ সত্বরূপো ভক্তিং লোকে কাশ্যতীতি ” ( সবার আত্মস্বরূপ মহাপুরুষ পরমাত্মাস্বরূপ মহাযোগী , ত্রিগুণাতীত , বিশুদ্ধ সত্বময় দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর স্বয়ং জাহ্নবীতীরে গোলোকাখ্য নবদ্বীপ ধামে শ্রীগৌরসুন্দর রূপে অবর্তীণ হয়ে জগতে ভক্তিপ্রকাশ করবেন ৷) ৷
গেরুয়া মানে আগুন বা বহ্নি ৷ আসলে জ্ঞানাগ্নি ৷সন্ন্যাসের মন্ত্র গুরুমুখে শুনতে হয় ৷এটাই শ্রবণ ৷
কিন্তু , নিমাই গুরু মন্ত্র গুরুকেই আগে শুনিয়েছিলেন ৷ যা তাঁকে গুরু দেন ৷ শ্রবন , মনন ও নিদিধ্যাসন ৷ ভগবান অবতার হয়েও তা দেখিয়ে দিয়েছেন ৷ সারা ভারত ঘুরে ধর্ম প্রচার করেছেন ৷
বুদ্ধদেবের মত ,” চরতি ভিক্ষবে চারিদিকম্ , বহুজন হিতায় বহুজন সুখায় “৷ জীবের প্রেমে ৷
মৎস্যপুরাণে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন ,” আমি কলিযুগে গঙ্গাতটে সুদীর্ঘ গৌরাঙ্গরূপে প্রকটিত হয়ে জগতের প্রতি করুণাবশত মুন্ডিত মস্তক সন্ন্যাসী বেশে সকলকে যুগধর্ম হরিনাম সংকীর্তন করাব ৷
( মুন্ডো গৌরঃ সুদীর্ঘ মিস্ত্রি স্রোতস্তীর সম্ভবঃ ৷
দয়ালু কীর্তনগ্রাহী ভবিষ্যামি কলৌযুগে ৷৷) ৷
মার্কন্ডেয় পুরাণে আছে -” গোলোকং চ পরিত্যক্তা
লোকনাং ত্রনিকারনাৎ ,/ কলৌ গৌরাঙ্গরূপেন লীলালাবণ্য বিগ্রহ ৷৷”
মহাভারতে কলিযুগে গৌরাঙ্গ অবতারের ভবিষ্যত বাণী রয়েছে ৷-” সুবর্ণবর্ণো হৈমাঙ্গ বরাদ্দশানন্দ নাঙ্গদী ৷/ সন্ন্যাস কৃচ্ছ্রমঃ শান্তো নিধাশান্তি পরায়ণ”
গদাধর পন্ডিতের সামনে নিজের চোখের জলে বিশ্বম্ভর ( নিমাই) এর পা ধুয়ে দিয়ে তাঁকে ( চৈতন্যদেব) অবতার হিসাবে ঘোষণা করেন ৷
নিত্যানন্দকে বলেন বলরামের অবতার ৷শ্রীবাস আচার্য ও মাধবেন্দ্র পুরী চিনেছিলেন নিমাইকে ৷
শুধু রামচন্দ্র বা কৃষ্ণ চৈতন্যরূপে আবির্ভূত হন নি৷
শ্রীরাধা হয়েছেন বিষ্ণুপ্রিয়া রূপে ৷ত্রেতা যুগে লক্ষ্মণ বা দ্বাপরে বলরাম হয়েছেন কলিতে নিত্যানন্দ ৷ অন্যরা হলেন – অদ্বৈত – মহাদেব,
জগন্নাথ মিশ্র – নন্দরাজ , শচীমাতা – যশোদা , গদাধর – শ্রীরাধার ভাবময় বিগ্রহ , শ্রীবাস – নারদ,
মুরারী গুপ্ত – হনুমান , কেশব ভারতী – অক্রুর ,
সার্বভৌম – বৃহঃস্পতি , কৃষ্ণদাস কবিরাজ -শুকদেব , পুন্ডরীক বিদ্যানিধি – বৃষভানু , গঙ্গাদাস-
দুর্বাসা , গোপীনাথ আচার্য – ব্রহ্মা , বৃন্দাবন দাস –
বেদব্যাস , সীতাদেবী – যোগমায়া , জগদানন্দ – সত্যভামা , উদ্ধারন দত্ত – সুবাহু , নীলাম্বর চক্রবর্তী – গর্গাচার্য , হাড়াই পন্ডিত – বসুদেব , পরমানন্দ পুরী – উদ্ধব , গৌরীদাস – সুবল , শ্রীধর – মধুমঙ্গল , হরিদাস – ঋচীক মুনির ছেলে ব্রহ্মা , প্রতাপ রুদ্র -ইন্দ্রদ্যুম্ন , স্বরূপ দামোদর – ললিতা , রামানন্দ রায় – বিশাখাা, শ্রীজীব – বিলাস মঞ্জরী , রূপ গোস্বামী – রূপ মঞ্জরী , সনাতন – লবঙ্গ মঞ্জরী , রঘুনাথ দাস – রতি মঞ্জরী ও রঘুনাথ ভট্ট – রাগ মঞ্জরী ৷এভাবে শ্রীকৃষ্ণ সপার্ষদ কলি যুগে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যর পার্ষদ হয়ে হরিনাম মহামন্ত্র বিলিয়েছেন ৷
আমার লেখা “সনাতনী কৃষ্টিকথা ” ও “হিন্দু ধর্ম ” বইদুটি পড়লে হিন্দু ধর্মের ইতিহাস , ঐতিহ্য , দেবদেবী , পূজা পার্বণ , ধর্মগ্রন্থ , তীর্থ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন ৷ বইয়ের দোকানে কিংবা আমার নম্বরে হোয়াটস এপ করে নিজের পুরো নাম , ঠিকানা , ফোন নম্বর পাঠিয়ে এবংএকেকটি বইয়ের দরুন তিনশো টাকা করে ৬০০ টাকা ফোন বা গুগুল পে করলে আমার সহকারী আপনার বাড়ীতে ক্যুরিয়ারে বইটি পাঠিয়ে দেবেন ৷
চৈতন্য মানে কনশাসনেস ৷ তাই , তিনি কখনো বর্ণাশ্রয়ী হিন্দু , মুসলমান সহ কোন ধর্মের নিন্দা করেন নি ৷ তাঁর উদার পরম আত্মধর্মে সব ধর্ম মতের মানুষ স্থান পেয়েছেন ৷ কেউ প্রত্যাখ্যাত হন
নি ৷ বলপ্রয়োগ , সমাজের উৎপীড়ন , নানা প্রলোভন , অর্থলোভ থেকে রাজনৈতিক কারণে
অসংখ্য হিন্দু অন্য ধর্ম গ্রহণ করলেও অন্যের হিন্দু
ধর্মগ্রহণে এর কোনটাই কখনো হয় নি ৷ শুধুমাত্র
সনাতন ধর্মের অমোঘ আকর্ষণ ছাড়া কেউ হিন্দু
ধর্মে প্রবেশ করেন নি ৷ বিশ্বের সব নগর গ্রামে
শ্রীচৈতন্যের ইচ্ছায় সনাতন ধর্ম ছড়িয়ে পড়ছে এভাবেই ৷ কলিযুগের মহামন্ত্র “হরেকৃষ্ণ হরেরাম “৷
” নমঃ ত্রিকাল সত্যায় জগন্নাথসূতায় চ ৷
স ভৃত্যায় সপুত্রায় সকল ত্রায়তে নমঃ ” ৷
” জয় গৌর ! হরি বোল !”(প্রথম ছবিটি মায়াপুরের “শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মস্থান মন্দিরের আর দ্বিতীয় ছবিটি নবদ্বীপ শহরের প্রাচীন মায়াপুরের “শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মস্থানের ৷)
শ্রীচৈতন্য দেব…তিনিই একমাত্র অবতার যিনি কোন অসুর বধের জন্য এ জগতে আসেন নি…. ৷

More from CultureMore posts in Culture »
- “ঠাকুর রামকৃষ্ণের জন্মদিনে ” ! সব ধর্মের মিলনতীর্থ ” কামারপুকুরে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্মভিটেয় “….।“ঠাকুর রামকৃষ্ণের জন্মদিনে ” ! সব ধর্মের মিলনতীর্থ ” কামারপুকুরে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্মভিটেয় “….।
- এশিয়াটিক সোসাইটিতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবন ও কর্মকান্ড নিয়ে প্রদর্শনী….।
- BookMyShow Foundation unveils BookAChange to democratise access to music and performing arts; pledges 500 music scholarships…
- আজকের দিনে বিশ্বম্ভর মিশ্র সন্ন্যাস গ্রহণ করে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নামে পরিচিত হন….।
- মা বিধ্যেশ্বরীর বিশাল বটগাছের প্রকান্ড বটের ঝরীর গহ্বরে মা হাজার হাজার বছর ধরে এক বিশাল সর্পের প্রহরায় বসে ছিলেন শয়ে শয়ে কিলো স্বর্ণালনকার নিয়ে….।
- ” বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ – কুম্ভমেলা “!….
More from InternationalMore posts in International »
- একুশে ফেব্রুয়ারী….।
- কেএসসিএইচ এবং ও ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগে স্বাস্থ্য পরিষেবায় উন্নতি উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর অঞ্চলে….।
- “ঠাকুর রামকৃষ্ণের জন্মদিনে ” ! সব ধর্মের মিলনতীর্থ ” কামারপুকুরে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্মভিটেয় “….।“ঠাকুর রামকৃষ্ণের জন্মদিনে ” ! সব ধর্মের মিলনতীর্থ ” কামারপুকুরে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্মভিটেয় “….।
- এশিয়াটিক সোসাইটিতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবন ও কর্মকান্ড নিয়ে প্রদর্শনী….।
- মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ৩-০ গোলে কেরল ব্লাস্টার্সকে হারিয়ে দিল…।
- শহর কলকাতায় “মেডিকল” এক্সিবিশনে ব্যাপক সাড়া….।
Be First to Comment