জন্মদিনে স্মরণঃ শো ভা সে ন
বাবলু ভট্টাচার্য : তাঁর সুদীর্ঘ জীবন তাঁকে প্রাচীন ও নব্যযুগের শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করার যেমন সুযোগ করে দিয়েছে, একই সঙ্গে তাঁর শিল্পচেতনায়, তাঁর অভিনয়ধারায় বেণিবন্ধন ঘটেছে সাবেকি ঘরানার সঙ্গে অধুনাতনের।
প্রগতিশীল ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মে তিনি আশৈশব লালিত হয়েছিলেন মুক্তচিন্তা ও সদ্ভাবনার উদার পরিবেশে, যা তাঁর কারু-বাসনাকে প্রশ্রয় দিয়েছিল, আনুকূল্য করেছিল তাঁর অভিনয়-জীবনকে সাবলীল ও নিরঙ্কুশ করতে। যদিও জীবনযাপনের প্রতিকূলতা, ব্যক্তিগত জীবনে চড়াই-উৎরাই তাঁকে অতিক্রম করতে হয়েছে বরাবর। তিনি শোভা সেন।
পুর্ববাংলার ফরিদপুরে ডাক্তার-বাড়িতে জন্মানো বেথুন কলেজের ছাত্রী শোভার সঙ্গে গণনাট্য সংঘের যোগাযোগ হয় বাম মনস্ক দেবপ্রসাদ সেনের সঙ্গে বিয়ের পরে। যদিও অভিনয়কে কেন্দ্র করেই অশান্তির সূচনা এবং বিচ্ছেদ। উৎপল দত্তকে বিয়ে করার পরে শোভার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এলটিজি বা পিএলটি গ্রুপে শোভার ভূমিকা ছিল অভিভাবকের মতোই।
উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্যদের সঙ্গে নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’, ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’-এর মতো ছবিতে অভিনয়ও করেছেন তিনি। অসমাপ্ত ছবি ‘বেদেনি’তেও অভিনয় করছিলেন।
১৯৫২ সালে হিন্দি ছবি ‘বাবলা’-য় অভিনয়ের সুবাদে দেশের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারও পেয়েছিলেন শোভা। উৎপল দত্তের পরিচালনায় ‘লেডি ম্যাকবেথ’-এর ভূমিকায় অভিনয় শোভার শিল্পীজীবনের আর একটি দিকচিহ্ন।
অভিনয়ের সুযোগ পান ‘নবান্ন’ নাটকে। এই নাটকে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। বাম রাজনীতিতেও তাঁর এখানেই হাতে খড়ি। এই অভিনয় নিয়েই পরবর্তী সময়ে স্বামীর সঙ্গে মতবিরোধ এবং বিচ্ছেদ। ১৯৬১ সালে দ্বিতীয় বিবাহ বিখ্যাত নাট্যকার অভিনেতা উৎপল দত্তের সঙ্গে।
সবসময় ছিলেন উৎপল দত্তের পাশে। মূলতঃ শোভা সেনের উৎসাহেই উৎপল দত্ত বাংলা নাটক পরিচালনা এবং অভিনয় শুরু করেন। স্বামী যাতে সারাক্ষণ থিয়েটারে কাজ করতে পারেন সেইজন্য শোভা সেন বহু সিনেমাতেও মায়ের রোলে বা কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু চলচ্চিত্রে তিনি কাজ করেছেনঃ ‘বেদেনী’ (ঋত্বিক ঘটকের অসমাপ্ত কাজ), ‘এক আধুরী কাহানী’, ‘ঝড়’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘বৈশাখী মেঘ’, ‘পসন্দ আপনি আপনি’, ‘দেখা’, ‘শ্যাডোস অব টাইম’।
কিন্তু মঞ্চের শোভা সেন অন্য ব্যক্তিত্ব। ‘কল্লোল’-এ বীর নাবিক যোদ্ধা শার্দূলের বীরাঙ্গনা মা কৃষ্ণাবাই। একই রকম তেজিয়ান চরিত্র ‘ফেরারী ফৌজ’-এ নায়ক অশোকের মা বঙ্গবাসী দেবী।
উৎপলবাবু যখন জেলে যান তখন ’এলটিজি’তে ভাঙন ধরে। অভাব, অনিশ্চয়তার মধ্যেও সংসারের, উৎপল দত্তের নাট্যজীবনের হাল ধরে রেখেছিলেন শোভা সেন। উৎপল বাবু ফিরে আসার পর আরো শক্তিশালী নাট্যদল ‘পিএলটি’ তৈরি করেন। পাশে সহধর্মিনী এবং সহযোদ্ধা শোভা সেন।
একের পর এক দুরন্ত নাটক ‘সূর্যশিকার’, ‘টিনের তলোয়ার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’। আর তাঁর প্রতিটিতেই শোভা সেনের দুরন্ত অভিনয়। জার্মানিতে গিয়ে অভিনয় করেছেন। উৎপল দত্তের সঙ্গে গেছেন মস্কো, চীন, ইংল্যান্ড।
২০১০ সালে পেয়েছিলেন মাদার তেরেসা আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখতে গিয়ে উৎপল দত্ত লিখেছিলেন, ‘ব্যারিকেডে দাঁড়িয়ে তুমি আর আমি/লড়ে যাচ্ছি দুই কমরেড।’
২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
শোভা সেন ১৯২৩ সালের আজকের দিনে (১৭ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment