জন্মদিনে স্মরণঃ প্র তি মা ব ড়ু য়া
বাবলু ভট্টাচার্য : ভাওয়াইয়া গান মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব যাদের তাদের মধ্যে আব্বাসউদ্দিন এবং সুরেন রায় বসুনিয়ার নাম আসে এবং এই দুজনের সাথে আসে প্রতিমা বড়ুয়ার নাম। আমাদের মন প্রাণ জুড়ে বিরাজ করে প্রতিমার লোকগান, যার আর্তি আর উদাত্তের জন্য হয়ে ওঠেন বাংলা লোকগানের রাজকন্যা।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিমা বড়ুয়া পাণ্ডে বিখ্যাত ছিলেন তাঁর অমর গোয়ালপাড়িয়া গান এবং ভাওয়াইয়া গানের জন্য। ‘হস্তির কন্যা’ এবং ‘মোর মাহুত বন্ধুরে’ তাঁর খুব বিখ্যাত দুটি গান। তিনি ছিলেন হাতি বিশেষজ্ঞ প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়ার কন্যা এবং ‘দেবদাস’ খ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়ার ভাইঝি।
‘গোয়ালপাড়িয়া গীত’ কথাটির প্রচলন তাঁর গানের মাধ্যমে ১৯৫৮ সালে শুরু হয়। তাঁর রেকর্ডভুক্ত গানের সংখ্যা রয়েছে অন্তত ৩২০টি– যেগুলো তিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৮৮ সালের ভেতরে গেয়েছিলেন।
ঋত্বিক ঘটক, প্রতিমা বড়ুয়াকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। প্রতিমার বাবা প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়াকে সেকথা জানালে, তিনি ঋত্বিক ঘটককে বলেছিলেন “বিয়ে যাকে করতে চাইছ, তাকেই গিয়ে প্রস্তাবটা দাও”। প্রতিমা বলেছেন, “ঋত্বিকদা বোধহয় সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারেন নি”।
পরে ঋত্বিক ঘটক তাঁর ‘বগলার বঙ্গদর্শন’ ছবিতে আটটি গান গাইয়েছিলেন প্রতিমা বড়ুয়াকে দিয়ে। ছবিটি শেষ না হওয়ায় ঋত্বিকের আফসোসের অন্ত ছিল না।
প্রতিমার মৃত্যুর পর ভুপেন হাজারিকা যে আবেগপূর্ণ লেখাটি লিখেছিলেন তা আমাদেরকে প্রতিমাকে চিনতে সহায়তা করে– “একটা জীবন যতটুকু দিতে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়ে গেছে প্রতিমা। জীবনের পায়ে পায়ে গানের খই ছড়াতে ছড়াতে মৃত্যুর দিকে চলে গেছে … রেখে গেছে বিশাল ভাণ্ডার। গোয়ালপাড়িয়া লোকগীতিকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছে। গার্হস্থ্য নিয়ে ভাবেনি, সৌখিনতা নিয়েও নয়। সাধারণ পোশাক-আশাক, অথচ কী অসাধারণ সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব।”
প্রতিমা বড়ুয়ার মায়ের নাম মালতীবালা বড়ুয়া। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন কলকাতার গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে এবং মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন অসমের গৌরীপুর বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৯৫৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সাউথ ক্যালকাটা গার্লস কলেজে ভর্তি হলেও লেখাপড়া শেষ করেননি।
লোকগানের প্রেরণা পেয়েছেন ভরতবালা রায়, শরতবালা রায় এবং সোনাইবালা রায়ের কাছে। লোকগানের প্রথম শিক্ষক ভবেন রায়। চটকাগানের শিক্ষক ছিলেন বয়ানউদ্দিন। তিনি রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলগীতি শিখেছিলেন মনোরমা বাই দেউরের কাছে।
প্রথম লোকগান পরিবেশন করেন ১৯৪৯ সালে কলকাতার নিউ এম্পেয়ার থিয়েটার হলে। ১৯৫৬ সালে ভূপেন হাজারিকার সুরে ‘এ্যারাবাটোর সুর’ ছবিতে লোকগান পরিবেশন করেন।
১৯৫৭ সালে ‘মাহুত বন্ধু রে’ চলচ্চিত্রে গান গেয়ে অসংখ্য মানুষের হৃদয় জয় করেন। এছাড়া জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ‘পলাশের রঙ’, ‘গজমুক্তা’ ও ‘বগলার বঙ্গদর্শন’ সিনেমায় গান পরিবেশন করেন। ১৯৬০ সনে আকাশবাণীতে অডিশন দিয়ে উত্তীর্ণ হন। তাঁর মোট রেকর্ডভুক্ত গানের সংখ্যা প্রায় ৩২০টি।
তিনি ১৯৬৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর গৌরীপুর প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক গঙ্গাশঙ্কর পাণ্ডেকে বিয়ে করেন। ১৯৭৫ সালে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের আমন্ত্রণে অনুষ্ঠান করেন। পরবর্তীতে তাঁর গান দিল্লি, সিমলা, শিলিগুড়ি, তেজপুর, শিলচর, কার্শিয়াং, গ্যাংটক, ডিব্রুগড়, ইম্ফল ও আগরতলা কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচার হয়েছে।
২০০২ সালের ২৭ ডিসেম্বর গুয়াহাটিতে এই মহান শিল্পীর প্রয়াণ ঘটে।
১৯৭৭ সালে তিনি ‘অসম সাহিত্য সভা’ কর্তৃক ‘অসম শিল্পী দিবস’ সম্মান অর্জন করেন। ১৯৮৮ সালে অর্জন করেন ‘ভারত সংগীত নাটক একাডেমী’ সম্মান এবং ১৯৯১ সনে পদ্মশ্রী উপাধি। ১৯৯৩ সনে ‘আব্বাসউদ্দীন স্মরণ সমিতি’ কর্তৃক বিশেষ সম্বর্ধনা। ২০০১ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট উপাধি প্রদান করে।
এছাড়াও আরো পুরস্কার ও সম্মাননা তালিকায় যেগুলো যুক্ত হয়েছেঃ জয়মতী সম্মান, বিষ্ণু রাভা সম্মান, অসম নাট্য সমিতি সম্মান, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সম্মাননা, ধুবড়ী চলচ্চিত্র উৎসব সম্বর্ধনা, বিপিন চক্রবর্তী স্মৃতি সম্মান ইত্যাদি।
প্রতিমা বড়ুয়া ১৯৩৫ সালের আজকের দিনে (৩ অক্টোবর) পশ্চিম আসামের ধুবড়ী জেলার গৌরিপুরের রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment