জন্মদিনে স্মরণঃ গৌরকিশোর ঘোষ
বাবলু ভট্টাচার্য : সাহিত্যসৃষ্টি এবং সাংবাদিকতা— এই দুটি বিষয়েই গৌরকিশোর ঘোষ ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ। এক দিকে তিনি যেমন ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘আমরা যেখানে’, ‘বাঘবন্দি’, ‘পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদ তরণী হাহা’ প্রভৃতি অসামান্য গল্পগ্রন্থের রচয়িতা, তেমনই ‘প্রেম নেই’-এর মতো উপন্যাস রচনা করেছেন, ‘রূপদর্শীর নক্সা’-র মতো রঙ্গব্যঙ্গ রচনাতেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী।
প্রাথমিক পড়াশোনা করেন শ্রীহট্ট জেলার এক চা-বাগানে। স্কুলের পাঠ নদিয়া জেলার নবদ্বীপে। ১৯৪৫ সালে আই. এস. সি পাশ করেন।
১৯৪১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত গৌরকিশোর ক্রমাগত পেশা বদলে গেছেন। প্রাইভেট টিউটর, ইলেকট্রিক মিস্ত্রী, খালাসি, রেস্তরাঁয় বয়, ট্রেড ইউনিয়ন অর্গানাইজার, ইস্কুল মাস্টার থেকে ভ্রাম্যমান নৃত্য-সম্প্রদায়ের ম্যানেজার, ল্যান্ডকাস্টমস ক্লিয়ারিং কেরানি, প্রুফ রিডারসহ অসংখ্য কাজ করেছেন সাংবাদিক জীবনে প্রবেশের আগে পর্যন্ত ৷
১৯৭৫ সালের ২৫ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। অভ্যন্তরীণ গোলযোগের জন্যে সংবিধানের ৩৫২ (২) ধারামতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। বিনা বিচারে আটক করার আইন ‘মিসা’ জারি করা হয়। প্রেস সেন্সরশিপ চালু করা হয়। আকাশবাণীর সম্প্রচার থেকে বহু বিষয় ছাঁটাই হতো। এমনকী রবীন্দ্রনাথের লেখার অংশও কেটে বাদ দেওয়া হতো।
জ্যোতির্ময় দত্ত সম্পাদিত ‘কলকাতা’ পত্রিকায় গৌরকিশোর ঘোষের একটি ঐতিহাসিক লেখা বেরোয়। এই লেখায় এক কিশোরকে তার বাবা চিঠি লিখছেন- ‘এই দেশে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে। এখন গোটা দেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করা হয়েছে। চার পাশে শুধুই সন্ত্রাস। আমাদের শিরদাঁড়াগুলো খুলে নিতে চাইছে। যাতে বুকে হাঁটতে আর আমাদের কষ্ট না হয়। পুরো সমাজটাকে টিকটিকি-আরশোলায় ভরে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে’।
গৌরকিশোর তখন থাকতেন পাইকপাড়ার সরকারি বাস ভবনের একটি ছোট ফ্ল্যাটে। বিশাল পুলিশবাহিনী সেই বাড়ি ঘিরে ফেলে। গৌরবাবুকে পার্ক স্ট্রিট থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে লক-আপে রাখা হয়। তিনি মামলা করে রাজবন্দির মর্যাদা আদায় করেন।
গৌরকিশোর ঘোষের ‘আমাকে বলতে দাও’ এবং ইংরিজিতে ‘লেট মি হ্যাভ মাই সে’ বই দুটিও নিষিদ্ধ করা হয়।
আশ্চর্যের কথা, গৌরবাবুকে কংগ্রেস বলতো বামপন্থী, বামপন্থীরা অনেকেই বলতেন আমেরিকার গুপ্তচর আর নকশালপন্থীদের এক অংশ তাঁর মুণ্ডু কাটার ফরমান জারি করেছিল।
আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করতেন তিনি। ‘দেশ’ পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। আশির দশকে আজকাল পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। দেশ-মাটি-মানুষ ট্রিলজির দ্বিতীয় খন্ড ‘প্রেম নেই’— গ্রামীন মুসলিম জীবন নিয়ে তার সুবিশাল রচনা। দেশ পত্রিকায় এই উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
এছাড়া ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘আমাকে বলতে দাও’, ‘আমরা যেখানে’, ‘লোকটা’, ‘রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য’ ইত্যাদি তার অন্যান্য গ্রন্থ।
সাগিনা মাহাতো তপন সিংহ’র পরিচালনায় চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দিলীপ কুমার। গৌরকিশোর সৃষ্ট মজলিশি চরিত্রের নাম ব্রজদা।
সাংবাদিকতার জন্যে তিনি ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘কো জয় উক’ স্মৃতি পুরস্কার এবং ১৯৮১ সালে ম্যাগসাসে পুরস্কারে সম্মানিত হন। একই বছর মহারাষ্ট্র সরকারের পুরস্কার, ১৯৯৩ সালে হরদয়াল হারমোনি পুরস্কার, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পুরস্কার লাভ করেন।
তিনি ১৯৭০ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৮২-তে বঙ্কিম পুরস্কার পান। কলকাতা মেট্রো রেলের নতুন প্রস্তাবিত চিংড়িহাটা স্টেশনটি গৌরকিশোর ঘোষের স্মৃতিতে রাখা হয়েছে।
২০০০ সালের ১৫ ডিসেম্বর মারা যান গৌরকিশোর ঘোষ।
গৌরকিশোর ঘোষ ১৯২৩ সালের আজকের দিনে (২০ জুন) বাংলাদেশের যশোর জেলার হাট গোপালপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment