স্মরণঃ অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ
“মৃত্যু নাই, নাই দুঃখ, আছে শুধু প্রাণ,
অনন্ত আনন্দ হাসি অফুরান…”
[ কাজী নজরুল ইসলাম ]
বাবলু ভট্টাচার্য : মৃত্যু তাকে ম্লান করতে পারেনি, পারেনি অগণিত মানুষের হৃদয়পট থেকে শিক্ষাবিদ, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রবিশারদ ও সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রসায়নবিদ, শহীদ যোগেশচন্দ্র ঘোষ’কে মুছে ফেলতে।
১৯৭১ সালের আজকের দিনে (৪ এপ্রিল) তাকে পাকিস্তানী ঘাতকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তারই প্রতিষ্ঠান সাধনা ঔষধালয়ে।
সাধনা ঔষধালয় এবং যোগেশচন্দ্র ঘোষ একটি ইতিহাস। তার জীবনের একমাত্র সাধনা ছিল ‘সাধনা ঔষধালয়’। যে প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি দেশ ছাড়িয়েও সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। সৃষ্টির মাঝেই যোগেশচন্দ্র ঘোষ বেঁচে আছেন আজও।
শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষের জন্ম ১৮৮৭ সালে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার জলছত্র গ্রামে। বাবা পূর্ণচন্দ্র ঘোষ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু গ্রামের স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী। লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখে বাবা ছেলেকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। ১৯০২ সালে ঢাকার জুবিলী হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা, ১৯০৪ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে এফএ পাস করে চলে যান পশ্চিমবঙ্গে।
১৯০৬ সালে কোচবিহার কলেজ থেকে স্নাতক, ১৯০৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর, এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড। সেখান থেকে এফসিএস। তারপর আমেরিকা থেকে এমসিএস।
চাকরি নিয়ে আমেরিকায় স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকতে পারতেন; তা না করে দেশে ফিরে ভাগলপুর কলেজে রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯১২ সালে একই পদে চলে আসেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। এ পদে ছিলেন ৩৫ বছর। ১৯৪৭ সালে কলেজের অধ্যক্ষ হন। ১৯৪৮ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে পড়ার সময় তিনি প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সান্নিধ্য পান। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ই তাকে দেশজ সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে উৎসাহ দেন।
প্রফুল্ল চন্দ্রের দীক্ষা ও নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে ১৯১৪ সালে, ঢাকার ৭১, দীননাথ সেন রোডে গড়ে তোলেন ‘সাধনা ঔষধালয়’। এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কাজে তার নিরলস গবেষণা এ দেশে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতি ও আয়ুর্বেদ ওষুধ প্রস্তুত প্রণালিকে আধুনিক মানে উন্নীত করে।
তিনি আয়ুর্বেদ শাস্ত্র সম্পর্কিত বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তার গ্রন্থাবলীর মধ্যে ‘অগ্নিমান্দ্য ও কোষ্ঠবদ্ধ’, ‘আরোগ্যের পথ’, ‘গ্রহ-চিকিৎসা’, ‘চর্ম ও সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি’, ‘চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা ও মুখরোগ চিকিৎসা’, ‘আমরা কোন পথে’, ‘আয়ুর্বেদ ইতিহাস, ‘Whither Bound Are We’, ‘Home Treatment’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
শহীদ যোগেশচন্দ্র ঘোষ ১৯১১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত লন্ডন কেমিক্যাল সোসাইটির ফেলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের কেমিক্যাল সোসাইটির সদস্য ছিলেন।
২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা সূচিত হবার পরদিন, তার পরিবারসহ অনেকে পুরনো ঢাকার সূত্রাপুর এলাকা ছেড়ে গেলেও যোগেশচন্দ্র থেকে যান। কারণ, তার একমাত্র সাধনাস্থল হলো সাধনা ঔষধালয়ের কারখানা।
বিরাট এলাকা জুড়ে সাধনা ঔষধালয় কারখানা। এখানেই তিনি কাটিয়েছেন জীবনের অধিকাংশ সময়, গবেষণা করেছেন! তার একমাত্র সাধনাস্থল এ কারখানার প্রতিটি ইটে আছে তার মমতার ছোঁয়া। নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সাথীরা ছিল কারখানার শ্রমিকরা। সবাই যখন কাজ সেরে ফিরে যেত তখন কেবল থাকতেন, সুরুজ মিয়া এবং রামপাল।
সুরুজ মিয়া এবং রামপাল কারখানার দারোয়ান। তারা দীর্ঘ ১৭ বছর যোগেশ বাবুর সঙ্গে কাটিয়েছেন। ২৫ মার্চের পর সবাই যখন একে একে যোগেশ বাবুকে ফেলে চলে গেলন, রয়ে গেলেন শুধু এই দু’জন মানুষ।
৩ এপ্রিল ১৯৭১, একটি মিলিটারী জীপ এসে থামে। ৫/৬ জন সশস্ত্র পাকিস্তানী সেনা সদস্য জীপ থেকে নামলো। সবার হাতে ভারী অস্ত্র। একে একে গেটের তালা ভেঙ্গে ফেললো তারা। কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়লো। কিন্তু সে মুহূর্তে মসজিদে ফজরের আযান শুরু হলে বর্বরের দল ভিতরে না ঢুকে চলে যায়।
পরদিন (৪ এপ্রিল ১৯৭১) সকালে, স্থানীয় পাকিস্তানের দালাল একদল পাকিস্তানী সৈন্য নিয়ে গেণ্ডারিয়ার ৭১, দীননাথ সেন রোডে সাধনা ঔষধালয়ের কারখানায় প্রবেশ করে। ‘নাশকতা’র কাজে সহায়তা করার অভিযোগে নীচে সবাইকে লাইন করে দাঁড় করায়। এরা যোগেশ বাবুকে উপরে নিয়ে যায়, রাইফেলের মুখে বৃদ্ধ যোগেশচন্দ্র ঘোষ কি বলেছিলেন তা কোনদিন আর জানা হবে না আমাদের। নীচে নামার সময় প্রত্যেকের হাতে ছিল দু’টি করে কাঠের পেটি। এগুলোতে ছিল মূল্যবান জাফরান, এলাচি, লবঙ্গ ইত্যাদি।
মিনিট দশেকের মধ্যেই পাকিস্তানী সেনা ও স্থানীয় শান্তি কমিটির দালালের দল হত্যাকাণ্ড শেষ করে চলে যায়। পিঠের বাঁ দিকে গুলি এবং পাঁজরে বেয়োনেটের আঘাত নিয়ে অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষের নিথর দেহ উপুড় হয়ে পড়েছিল মেঝেতে।
পাকিস্তানী সৈন্যরা ও গেণ্ডারিয়া এলাকার শান্তি কমিটির সদস্যরা শুধু তাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, লুটে নিয়ে গিয়েছিল যোগেশ বাবুর অর্জিত সমস্ত সম্পদ।
Be First to Comment