Press "Enter" to skip to content

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন গলায় বোর্ড ঝুলিয়ে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে সেসবের ছবি আঁকেন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে……।

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ শি ল্পা চা র্য জ য় নু ল আ বে দি ন

১৯৪৩ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ এর দিকে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী মোড়লদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ ভারতবর্ষে। রাস্তায় তখন কঙ্কালসার মানুষ ও কুকুর একই কাতারে। অনাহারে মৃত মায়ের স্তন পান করছে শিশু। ডাস্টবিনে কুকুর। কাক আর মানুষের উচ্ছিষ্টের জন্য মারামারি। কোথা থেকে যেন শকুন-কাক দুর্ভিক্ষে মৃত প্রাণীর দেহ ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে কলকাতার রাস্তায়।

উনত্রিশ বছর বয়সের আর্ট স্কুলের এক শিক্ষক এসব দেখে শিউরে উঠেন। ডুকরে কেঁদে উঠে তার মন। গলায় বোর্ড ঝুলিয়ে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে সেসবের ছবি আঁকেন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে।

মানবদরদী এই মানুষটি ‘শিল্পাচার্য’ নামে খ্যাত জয়নুল আবেদিন।

বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর, আর মা জয়নবুন্নেসা গৃহিণী। তাদের পৈত্রিক বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ শহরের পাশে কাঁচিঝুলি গ্রামে। বাবার চাকরির সুবাদে জয়নুল আবেদিনের ছোটবেলা কেটেছিল নানা প্রান্তে, নানা অঞ্চলে। কিশোরগঞ্জের কেন্দুয়াম, শেরপুর, নেত্রকোণাসহ নানা জায়গায়।

বাবা পুলিশের দারোগা, কতো টাকা আর বেতন! টানাটানির সংসার। কিন্তু ছেলে জয়নুল ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে ভীষণ ভালোবাসে। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফল এঁকে মাকে দেখাত সে। অবশ্য শৈশবে জয়নুল ছিলেন শান্ত, কম কথা বলা ছেলে। পাড়ার লোকেরা বলতো ঠান্ডার বাপ। ডাকনাম টুনু। জয়নুল বেশ মেধাবী, পড়তে বসলে অল্পক্ষণেই পড়া হয়ে যেতো, দারুণ মনোযোগী ছাত্র।

জয়নুলের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সূচনা হয় ১৯২২ সালে শেরপুরের রামবঙ্গিনী এম-ই স্কুলে। সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল জয়নুল। তারপর ময়মনসিংহ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করা হলো তাকে। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া।

কিন্তু আর্ট কলেজের স্বপ্নে কিছুতেই মন বসে না জয়নুলের। ওখানেই পড়া চাই। আর্ট কলেজে পড়ারও বেশ খরচ, আবার এতো দূরে কলকাতায় যাওয়া। কই ময়মনসিংহ আর কোথায় কলকাতা। কিন্তু জয়নুলের জেদ সে আর্ট স্কুলেই পড়বে। শেষমেশ ছেলের জেদ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে সেই টাকা ছেলের হাতে তুলে দিলেন।

তেতাল্লিশে বাংলার দুর্ভিক্ষ জয়নুল আবেদিনকে একেবারে বদলে দিল। গ্রাম-বাংলার রোমান্টিক নিসর্গ শিল্পীকে রূপান্তরিত করে ফেলে এক দুর্দান্ত বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বে। তারপর থেকে সারাটি জীবনই বিক্ষুব্ধ থেকে গেছেন তিনি।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকায় চলে এলেন জয়নুল আবেদিন। ঢাকায় এসে ধরন পাল্টালেন তিনি। নিজেকে নতুন করে সাজালেন। পঞ্চাশের দশকে লোকশিল্পের মোটিফ নিয়ে ছবি আঁকা শুরু করলেন। পাশাপাশি পূর্ববাংলার মানুষ, পশুপাখি, প্রকৃতি নিয়ে তেলরঙ, জলরঙ এবং টেম্পেরায় নিজস্ব একটি ধরন গঠন করে কাজ করতে লাগলেন।

লোকশিল্পের প্রভাবে তার আকার দিক এবং বাস্তবধর্মী অন্য ধরনটিতে ভিন্নতা থাকলে একই শিল্পীর আঁকা ব্যাপারটি ঠিকই প্রতিষ্ঠিত ছিল। অসাধারণ দক্ষতায় তিনি দুই ঢংকে একই সময়ে পাশাপাশি এঁকে গেছেন। এটি বিরল ঘটনা।

জয়নুল আবেদিন লোকশিল্পের আদলে ছবি আঁকতে গিয়ে লোকজ মোটিফগুলোকে হুবহু ব্যবহার করেননি। রঙের ব্যাপারেও লোকজ ছবির কাঁচা রঙকে পরিহার করেছেন। সেই সঙ্গে টোনাল তারতম্যও ব্যবহার করেছেন প্রয়োজনে। তিনি অনুকরণকে প্রশ্রয় দেননি বরং ফর্মগুলোকে সহজ করে এক ধরনের আধুনিক রূপ এনেছিলেন।

জয়নুলের বেশকিছু স্কেচ ধর্মী ছবি আছে। এগুলো মূলত ভ্রমণের কারণে। পঞ্চাশের দশকে তিনি প্রচুর ভ্রমণ করেছেন, দেশবিদেশ ঘুরেছেন। ওই সময়েই আঁকা। তবু তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, “দেশ বিদেশে ঘোরা আর হরেকরকম অন্যান্য কাজ করতে গিয়া সময় ন্যস্ত হইছে অনেক। পুরোদমে ছবি নিয়া থাকা হইলো না।”

আসলে কখনোই পুরোদমে ছবি আঁকার সুযোগ পাননি জয়নুল আবেদিন। তার কারণ তাকে চিত্রকর্মের বাইরেও বহু কিছু করতে হয়েছে। ঢাকা আর্ট কলেজ (যা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট), সোনারগাঁয়ে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন (যা এখন লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর) গড়েছিলেন তিনি। একাধারে আবার শিক্ষকতা, দেশের বাইরে বাংলার চিত্রকর্ম উপস্থাপনা।

সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর ত্রাণকর্মীদের সঙ্গে সরাসরি উপস্থিত ছিলেন জয়নুল আবেদিন। উপকূলীয় এলাকার মানুষের দুঃখ দুর্দশা, ধ্বংসলীলা দেখে প্রচণ্ড মর্মাহত হয়েছিলেন জয়নুল। ঠিক করেছিলেন সেসব নিয়ে ছবি আঁকবেন। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এঁকেও ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ জয়নুলকে প্রচণ্ড আলোড়িত করেছিল। দেশ স্বাধীনের পর লেগে গেলেন শিল্পচর্চা সংগঠনের কাজে। এবারে লোকশিল্প পূর্ণ মনোযোগ তার। স্বপ্ন দেখতেন লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানের সরকার জয়নুল আবেদিনকে দায়িত্ব দিলেন বাংলাদেশের সংবিধানের অঙ্গসজ্জার জন্যে। তিনিও বিনা বাক্যে রাজি। তাকে সাহায্য সহযোগিতা করেন আরও কয়েকজন শিল্পী।

যদি বলা হয় বাংলাদেশের চিত্রকলা কিংবা পূর্ববঙ্গের চিত্রকলার জনক কে তবে নিঃসন্দেহে প্রথম উত্তরই হবে জয়নুল আবেদিন। এদেশের চিত্রকলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জনক তিনি। তাইতো তিনি ‘শিল্পাচার্য’। কেবল পূর্ববঙ্গই নয়, উপমহাদেশের চিত্রকলার ইতিহাস বলতে গেলে অবলীলায় স্থান পাবে তার নাম। তাকে ছাড়া চিত্রকলা অসম্পূর্ণ। তাইতো শিল্পাচার্য বাংলার বুকে একজনই। তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।

১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পুরস্কার প্রদান করেন চিত্রাঙ্কনে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য।
বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করেন।

১৯৭৬ সালের ২৮ মে শিল্পাচার্য মৃত্যুবরণ করেন। চারুকলা ইনস্টিটিউটে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ১৯১৪ সালের আজকের দিনে (২৯ ডিসেম্বর) কিশোরগঞ্জের কেন্দুয়া-তে জন্মগ্রহণ করেন।

More from SocialMore posts in Social »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.