” আদি শঙ্করাচার্য ( ADI SANKARACHARYA)!”
——————————————————————-ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ৪ ডিসেম্বর ২০২১। নানা কারনে পিছিয়ে পড়া “সনাতন হিন্দু ধর্মকে ” পুনরায় জাগিয়ে তুলেছিলেন স্বল্পায়ু এই অদ্বৈত বৈদিন্তিক দার্শনিক ” শঙ্করাচার্য ” ৷ মাত্র ৩২ বছরের জীবনে তিনি হিন্দু ধর্মকে সুসংহত রূপ দেন ৷ যার ফলে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রভাব কমতে থাকে ৷ মহর্ষি বেদব্যাসের পর আচার্য শঙ্কর ছিলেন জ্ঞান মার্গের শ্রেষ্ঠ পথ প্রদর্শক ৷ উদারপন্থী শঙ্কর অনেক পন্ডিতকে বিচারে পরাজিত করলেও কাউকে স্ব ধর্ম ত্যাগ করতে বলেন নি ৷ বিকৃত ধর্মকে ক্রটি মুক্ত করেছিলেন ৷ অদ্বৈতবাদী হলেও বাস্তবে তিনি ছিলেন ভক্তি , জ্ঞান ও যোগ সাধনার উপাসক৷ তিনি ভগবান বুদ্ধকে বলেছিলেন বিষ্ণুর অবতার৷ বৌদ্ধরা না মানলেও তিনি বলেছিলেন গৌতম বৈদিক মতে সাধনা করে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন৷ তিনি এও বলেছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের শূণ্যময় তত্ত্ব , আনন্দময়ে রূপান্তরিত হয়ে সাধক পরমানন্দ লাভ করেন ৷ তিনি সাংখ্য বিবর্তনবাদ , জৈন স্যাৎবাদ ও বৌদ্ধ ক্ষণিকত্ববাদকে খন্ডন করেছিলেন ৷ শঙ্কর বলেছেন ,”ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ “অর্থাৎ “একমেব অদ্বিতীয়ম ব্রহ্ম” একমাত্র সত্য , তাঁর কোন দ্বিতীয় নেই ৷ সঠিক জ্ঞানের অভাবে মানুষ তা বুঝতে পারে না ৷ অর্থাৎ জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন৷ তিনি ব্রহ্মসূত্রভাষ্য , গীতাভাষ্য , বিভিন্ন উপনিষদের ভাষ্য , বিষ্ণু সহস্রনাম ভাষ্য , হস্তামলকভাষ্য ও বিবেক চূড়ামণি সহ বহু গ্রন্থ রচনা করেন ৷
কেরালার কালাডি গ্রামে শিব ভক্ত দম্পতি শিব
গুরু ও সতীর পুত্র শঙ্কর ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহন
করেন ৷ মাত্র দু’বছর বয়সে প্রাথমিক পাঠ শেষ করে বাবার মুখে শুনে বেদ , উপনিষদ ও পুরাণের
বহু শ্লোক আত্মস্থ করতে সক্ষম হন ! তিন বছর বয়সে তাঁর চূড়াকরণ হয় এবং বাবার মৃত্যু হয় ৷ এরপর গুরুর কাছে সাত বছরের মধ্যে চার বেদ , উপনিষদ ও দর্শন শাস্ত্রে পারঙ্গম হয়ে ওঠেন। আটবছর বয়সে সন্ন্যাস নেন৷ অনেকের সামনে তিনি নাকি হেঁটে কাশীর গঙ্গা পেরিয়েছিলেন ৷ তাঁর প্রতি পদক্ষেপে নাকি পদ্মফুল ফুটে উঠেছিল ৷ তিনি সনাতনীদের মাঝে সর্বত্র গণেশ , শিব , সূর্য , বিষ্ণু ও পার্বতী পাঁচ দেবতার পূজা চালু করেছিলেন ৷ ভূত , নৃ , পিতৃ , দেব ও ব্রহ্ম পাঁচ যজ্ঞের প্রচলন করেন ৷ দেশের চার প্রান্তে দক্ষিণে কর্ণাটকে শৃঙ্গেরী , উত্তরে বদরিকা আশ্রমের কাছে জ্যোর্তি/ যোশি মঠ ,পূর্বে উড়িষ্যার পুরীতে গোবর্ধন মঠ এবং পশ্চিমে
গুজরাটের দ্বারকায় সারদামঠ প্রতিষ্ঠা করেন ৷ দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরমের শৃঙ্গেরী মঠে সুরেশ্বরাচার্য , উত্তরে বদরিকাশ্রমে জ্যোর্তিমঠের অধ্যক্ষ করেন আনন্দগিরি বা তোটকাচার্যকে , পূর্বে পুরীধামে গোবর্ধন মঠে শঙ্করের প্রথম শিষ্য সনন্দন বা পদ্মপাদাচার্যকে এবং পশ্চিমে দ্বারকাধামের সারদা মঠে একসময়ের বোবা আসলে ব্রহ্মজ্ঞ হস্তমলকাচার্যকে অধ্যক্ষ করে যান ৷ যা আজও পরম্পরা মেনে শঙ্করাচার্য উপাধি নিয়ে চলে আসছে ৷ রক্ষা ও প্রচার করছেন হিন্দু ধর্মকে ৷ সর্বস্তরের হিন্দু সন্ন্যাসীদের চার মঠের আওতায় এনে পুরী , গিরিা, সরস্বতী , ভারতী , বন, অরণ্য , পর্বত , আশ্রম ও সাগর যে যার উপযুক্ত এই নামে পরিচিত করেন ৷ তাই এঁদের বলা হয় ” দশনামী সন্ন্যাসী ” ৷ যোশীমঠে -গিরি, সাগর , পর্বত ৷ শৃঙ্গেরী – ভারতী , সরস্বতী ও পুরী ৷ গোবর্ধন – বন ও অরণ্য এবং শারদামঠের অধীন – তীর্থ ঔ আশ্রম সম্প্রদায়৷ শঙ্করাচার্য জ্যোর্তিলিঙ্গ ও বিলুপ্ত তীর্থস্থান উদ্ধার ও প্রতিষ্ঠা করেন ৷ উপনিষদ , ব্রহ্মসুত্র ও গীতার ভাষ্য বা টীকা এবং দেবদেবীর স্তবস্তুতি ও পূজার সম্মত পদ্ধতি রচনা করেন ৷
তিনি বলেন “ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নিপরঃ” মানে ব্রহ্ম সত্য , জগৎ মিথ্যা , জীব ব্রহ্মই অন্য কিছু নয়৷ বেদের চার মহাবাক্য “তত্বমসি” , “সোহহং” , অহং-
ব্রহ্মাস্মি ” , ” অয়মাত্মা ব্রহ্ম ” হলো পরমব্রহ্মের সঙ্গে আপন আত্মার অভিন্নতা যা অদ্বৈত দর্শন ৷
তাই শঙ্করাচার্য ছিলেন লোকশিক্ষক ব্রহ্মজ্ঞানী ৷
৮২০ সালে উত্তরাখন্ডের কেদারনাথে শিব অবতার
আদি শঙ্করাচার্য দেহ রাখেন ৷ রামকৃষ্ণ পরমহংস ছিলেন পুরী সম্প্রদায়ের তোতাপুরীর শিষ্য ৷ দ্বৈতবাদী হলেও শ্রীচৈতন্যদেব দীক্ষা নিয়েছিলেন “কেশব ভারতীর ” কাছে ৷ শঙ্কর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন আশ্রমে এই প্রতিবেদক দর্শনে গিয়েছিলেন। বেদান্ত দর্শন তথা সনাতন ধর্মের সার কথা জানতে ৷ যেখানে নেই ভেদাভেদ ৷ কাঞ্চির শঙ্করাচার্য জয়েন্দ্র সরস্বতীর কৃপা পেয়েছেন এই প্রতিবেদক৷ তিনি দেখা মাত্রই আমাকে ও আমার ছেলেকে দিয়েছিলেন তাঁর নিজের রুদ্রাক্ষ ৷ আমার শ্বশুর মশাই তাঁর কাছে পেয়েছিলেন বিশিষ্ট পন্ডিত হিসাবে পদক , উত্তরীয় ইত্যাদি ৷ কাশী ও পুরীতে শঙ্করমঠে গিয়ে এই সকল জ্ঞান পিপাসু , নির্লোভ সন্ন্যাসীদের দেখে প্রতি মুহূর্তে এই প্রতিবেদক অবাক হয়েছেন। জয়তু শঙ্করাচার্য ৷
ফোটো – কৃতজ্ঞতা স্বীকার গুগুল।
Be First to Comment