জন্মদিনে স্মরণঃ বিপ্লবী বীণা দাস
বাবলু ভট্টাচার্য : পরাধীন ভারতবর্ষে, অগ্নিযুগের বিপ্লবী লড়াই-সংগ্রাম ও আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকেই অসংখ্য নারী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে। সেই উত্তাল সময়ে বেড়ে ওঠেন বেণী মাধব-সরলা দেবীর দুই বিপ্লবী কন্যা- কল্যাণী ও বীণা দাস।
বিপ্লবী সংগ্রামের অগ্নিচ্ছটা স্পর্শ করে তাদের, অনুরণিত করে তাদের স্বাধীনতাকামী সংবেদনশীল কিশোরী মনকে।
বীণা দাসের চার বছরের বড় বোন কল্যাণী দাস ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি গোপন সভার লিফলেট বহন করার দায়ে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান। উচ্চশিক্ষিত কল্যাণী দাস অনার্স গ্রাজুয়েট হওয়া সত্ত্বেও তাকে কারাগারে তৃতীয় শ্রেনির বন্দীর কাতারে রাখা হয়।
কারাবাসের সেই অবর্ণনীয় কষ্ট খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করেন কল্যাণী দাসের ছোট বোন বীণা দাস। বোনের এই আত্মত্যাগ তাকে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় শাণিত করে, অনুপ্রাণিত করে উপনিবেশিক শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
বেথুন ও ডায়সেশন কলেজে শিক্ষাগ্রহণ করা বীণা স্নাতক হন ১৯৩১ সালে। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে যখন বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছিল বীণা তখন বেথুন কলেজের ছাত্রী। তিনি অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে সায়মন কমিশন বয়কট করেন ও বেথুন কলেজে পিকেটিং করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
১৯৩২ সালে বীণা দাস তার জীবনের সবচাইতে দুঃসাহসিক কাজ করার জন্য মনস্থির করে ফেলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন বাংলার ব্রিটিশ গভর্ণর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করে হত্যা করার।
স্ট্যানলি জ্যাকসন ছিলেন একসময়ের ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের অধিনায়ক, যিনি ২০টি টেস্ট ম্যাচ খেলেন এবং ৫টিতে অধিনায়কত্ব করেন। পরবর্তীতে কনজারভেটিভ পার্টির হয়ে নির্বাচন করে ১৯১৫ সাল থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন।
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বীণা দাস সাহায্য নেন তার দিদি কল্যাণীর বান্ধবী কমলা দাসগুপ্তের। কমলা দাসগুপ্ত ‘যুগান্তর’ দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। বীণা দাস যুগান্তরের সদস্য না হলেও, তার সংকল্প এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় সন্তুষ্ট হয়ে কমলা দাসগুপ্ত, বীণাকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
বীণাকে রিভলবার সাপ্লাই দেন কমলা দাশগুপ্ত। তিনি বীণাকে রিভলবার চালানোর কৌশল শেখান। কিন্তু স্থানাভাবে বীণা তখন আর টার্গেট প্রাকটিস করার সুযোগ পান নি।
১৯৩২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি গভর্ণর স্ট্যানলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সিনেট ভবনে আসেন। সমাবর্তন অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে চলে প্রায় ১ ঘন্টা। গভর্ণর যখন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ পাঠ শুরু করেন তখন বীণা মঞ্চের কাছে গিয়ে গুলি চালান জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে।
আত্মরক্ষার্থে স্টানলি জ্যাকসন মাটিতে পড়ে যান। অল্পের জন্য বীণা দাসের লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়। গভর্ণর ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা তৎক্ষণাৎ দৌড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যায়।
বীণাকে গ্রেফতার করা হয়। টানা ৪৮ ঘন্টা বিরতিহীনভাবে চলে জিজ্ঞাসাবাদ। রিভলবারের উৎস জানতে বীণার ওপর চালানো হল নির্যাতন। বীণা মুখ খোলেন না। তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে নির্ভীকচিত্তে গভর্ণরের উপর হামলার সকল দায়- দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে জবানবন্দি দেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি বিচারে বীণা দাসের ৯ বছরের কারাদন্ড দেয় আদালত। সাত বছর কারাভোগের পর তিনি ১৯৩৯ সালে মুক্তি লাভ করেন।
সে সময়ে অনেকের মতো বীণাও কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ট্রেড ইউনিয়নের কাজ আরম্ভ করেন। তিনি দক্ষিণ কলকাতা জেলা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদিকাও ছিলেন। সে সময় বীণা দাসের সাহিত্যপ্রতিভা ও দেশাত্মবোধক চিন্তার প্রকাশ পাওয়া যায় কমলা দাস গুপ্ত সম্পাদিত ‘মন্দিরা’ পত্রিকায়।
১৯৪২-এ ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু হলে বীণা দাস দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সভা ডাকলেন হাজরা পার্কে। সভাকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। পুলিশ আবারো বীণাকে গ্রেফতার করে। তিনি রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে প্রেসিডেন্সি জেলে তিন বছর আটক থাকেন। এ দফায় ১৯৪৫-এ তিনি মুক্তি লাভ করেন।
স্বাধীনতার পর তিনি কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচন করে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার প্রভাব বীণা দাসকে ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। বীণা দাসের স্বামী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ যতীশ ভৌমিক।
স্বামীর মৃত্যুর পর বীণা দেবী আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে যান রাজনীতি থেকে এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান।
কখন যে তিনি হরিদ্বার চলে গিয়েছিলেন তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেন না। ১৯৮৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর। হরিদ্বারে গঙ্গার ঘাটে এক অজ্ঞাতপরিচয় বয়স্কা মহিলার দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সেই নারী ছিলেন বীণা দাস।
বীণা দাস ১৯১১ সালের আজকের দিনে (২৪ আগস্ট) পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment