Press "Enter" to skip to content

জাপানের মেয়েরা আমাদের এই বাঙালি মেয়েদের মতোই ফিশফিশ করে নিজেরা-নিজেরা কী সব গোপন কথা বলে, মন্তব্য করে, আর ফিক্ করে হাসে।

Spread the love

///////[প্রদীপের সঙ্গে আলাপ=প্রলাপ]\\\\\
===(পর্ব- ০৫৪)===
মঞ্চ-মায়াবী, জাদুশিল্পী পি সি সরকার জুনিয়র
(Dr.Prodip Chandra Sorcar, M.Sc., Ph.D.)


যেখানে লজ্জা - ঘেণ্ণা - ভয় ___তিনটেই থাকতে হয়।___ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নাকি বলেছিলেন,"লজ্জা- ঘেণ্ণা -ভয়, তিন থাকতে নয়।" খুব সহজ, সরল ভাষায় তিনি বি-রা-ট একটা দার্শনিক তত্ত্বকে আমাদের মতো করে বোঝাতে চেয়েছিলেন। কে এটার, কতোটা বুঝেছেন, মেনেছেন, জানিনা। কিন্তু আমি যে বেশ অনেকটাই কম বুঝেছি, তা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। আগে আগে ভাবতাম, আমি বুঝেছি, এবং সেই 'বুঝেছি' ভেবেই অক্ষরে অক্ষরে মানবার চেষ্টা করতাম । এ নিয়ে এখানে সেখানে অনেক বড় বড় কথাও বলতাম। কতো লোকের সঙ্গে তর্কও করেছি। কিন্তু, অকপটে স্বীকার করছি, জাপানে সেই ১৯৬৪-তে প্রথমবার গিয়েই, আমার অজ্ঞতা সম্পর্কে চেতনা জাগে এবং সেই চেতনাটা আমায় বেশ নির্লজ্জ, হ্যাংলা, আর নির্বোধ তকমা দিয়ে ভুগিয়েছে । তখন থেকেই এ ব্যাপারে আমি কট্টর নিরুত্তরবাদী হয়ে গেছি , কেউ প্রশ্ন করলে, একদম স্পিকটি নট্, 'টু'-শব্দটাও করিনা। তারপর অনেক ডজনবার জাপানে গেছি, কিন্তু প্রতিবারই সচেতন হয়ে থাকি, যদি ওদের 'উৎসুনোমিয়া' শহরের দিকে যেতে হয়, তাহলে এড়িয়ে যাই।!!! শুধু তাই নয়, সেখানকার বাসিন্দা, আমার কাছাকাছি বয়সের সুন্দরী মহিলাদের সঙ্গে যদি কথা বলতেই হয়, তখন খুব গম্ভীর হয়ে, চোখ অন্য দিকে রেখে কথা বলি। এমনিতেই জাপানের মেয়েরা আমাদের এই বাঙালি মেয়েদের মতোই ফিশফিশ করে নিজেরা-নিজেরা কী সব গোপন কথা বলে, মন্তব্য করে, আর ফিক্ করে হাসে। তা শুনে আবার শ্রোতা মেয়েটাও হেসে কুটি পাটি খায় । ফলে আমার (আমাদের?) মনে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক! কে জানে রে বাবা, কি কারণে আমি (?) এই হাসির খোরাক হলাম !! রুমাল দিয়ে মুখ মুছি, জামা-কাপড়-প্যাণ্ট এক ঝলকে দেখে নিই সব ঠিক আছে কিনা। তারপর বোকার মতো হেসে ওদের দৃষ্টিপথ অনুসরণ করি। হয়তো বা প্রশ্নই করে বসি, "হাসছো কেন?"। জবাবে পৃথিবীর সর্বত্র সেই একই রহস্যময় জবাবটাই আমি পাই, " কোই ? হাসছি না তো!!! এমনি এমনি একটা কথা বলছিলাম..!" বলেই আবার মুখ চাপা দিয়ে ফিক করে হেসে ফ্যালে !

এই জবাবটা চিরন্তন, সব সময়েই এক। কিন্তু কেন জানিনা, তবুও প্রশ্নটা করে ফেলি।
প্রমাণিত হই, আমি বোকা !
মেয়েদের ভাষায়, “বোকা-বোকা”! অবশ্য আজকের জনারেশনে এমনটা ঘটে কিনা জানিনা। অতোটা 'কুল' বা 'স্যাভি' আমি নই। হতে পারিনি। কানে কানে কথা বলতে কাউকেই আমি দেখি না। তাই জানতেও চাইনা। কানে কানে বলার কথাটা কি মোবাইলে বলা যায়?

সেজন্যই কি জন্ম নিয়েছে ওই সংক্ষিপ্ত বানানের এস -এম-এস ? যাই হোক, জাপানের কথায় ,আসি। ওদেশের মেয়েরা হাসে। ফিক্ করেই হাসে। তবে ডান হাতের পাতাটা উল্টো করে ধরে, মুখে নখ চাপা দিয়ে হাসে। যিনি শোনেন, তিনিও তাঁর বাঁ হাতের পাতা উলটে নিজের ঠোট চাপা দেন এবং দুজন-দুজনের দিক একটু কাত হয়ে এগিয়ে, মানে আরও ডেঞ্জারাস ভঙীমায় হাসেন। সদ্য বিধবা 'মোনালিসা', তাঁর প্রেমিক 'দ্য ভিঞ্চি'র দিকে রহস্যময়ী সেই গোপন- নিশ্চিন্তির চোখে কুহকের হাসির চেয়েও ম্যাজিকের রহস্যে মোড়া মায়া-ময়ী এই হাসি। তখন সবে জাপানে এসেছি। ভাষাটাকে ঠিক কব্জায় আনতে না পারলেও, ভালো লাগতে শুরু করেছে। এঁদের লেখার হরফ বা ধারা তিন রকমের। কাতাকানা, হিরাকানা এবং কান্ঞ্জি। প্রথম দুটো ধারা মোটামুটি শেখা যায়। কিন্তু ওই 'কান্জ্ঞি' ব্যাপারটা !?! ওরে ব্বাপ্ ওটা শিখতে মহাপুরুষ হতে হবে। শুনেছি, সাড়ে তিন হাজার নাকি ওর অক্ষর। নিজে লিখে, লেখক নিজেই অনেক সময় পড়তে পারেন না। অ্যাতো কাটাকুটি আর কিরিকাটা, যে মনে হয় ফলুই মাছের শুটকির কাটার ওপর দুটো হুলো বেড়াল, মালিকানা নিয়ে লড়াই করেছে, তার আঁচড়ের দাগ । শিখতে চাওয়াটাই বিপজ্জনক । সেজন্য চেনা জানা , প্রয়োজনীয় কয়েকটা ছাড়া আর কিছু 'কাঞ্জি'তে লেখা শিখবো না বলে ঠিকই করে নিয়েছিলাম। সত্যিই, ব্রেণে খণ্ডযুদ্ধ লাগিয়ে লাভ কি ? জাপানে বাবা প্রত্যহ দুটো করে 'শো' করতেন। ফলে শো করার পর, ক্লান্ত বাবাকে আর তার সঙ্গে, দলের মেয়েদেরকে আগে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে গাড়িগুলো ফিরে আসতো আমাদের নিতে। আমরা পুরুষেরা ততক্ষণে স্টেজটাকে আবার গুছিয়ে রাখতাম , যাতে পরের দিন একটু আয়েসে 'শো' শুরু করতে পারি। যে দিনটার ঘটনা, সেদিন আমি আর মাধব বাবু যন্ত্রপাতিতে রং করবো বলে ঠিক করে ছিলাম। ফলে, সব্বাই চলে গেলেও, আমাদের দুজনের ফিরতে আরও একটু বেশি দেরী হবে । ঠিক তাই। শেষ হয় বেশ গভীর রাতে, এবং কালি ঝুলি মেখে।হোটেলে ফিরে স্নান না করলেই নয়। শোয়া যাবে না। মাধবাবুকে আপনারা চেনেন। বাবার একান্ত সহকারী। আমার দাদা+বন্ধু স্থানীয় আদর্শ ব্যক্তিত্ব।

ইন্দ্রজাল সম্প্রদায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতা। আমার সব কাজের ছায়াসঙ্গী, সাক্ষী।
ওদিকে,জাপানে স্থানীয় মানুষদের, রাতে খেয়ে শুতে যাবার আগে, স্নান করে নেওয়ারও রেওয়াজটা আছে। কিন্তু সেটা এত রাতে নয়। সুতরাং, সব ফাঁকা। সেদিন আমাদের একটু বেশি রাতই হয়ে গেছিলো। জাপানের সাবেকি হোটেলকে বলে 'রিওকান'। সেখানে কোনো ঘরেরই দরজায় ছিটকিনি নেই। থাকেনা। এমন কি বাথরুমেও নেই। সেজন্য ভেতরের কাজকর্ম সব আতঙ্কের সাথে সাড়তে হয়। অশান্তি। কে কখন অসময়ে দরজা খুলে ফেলে, সেই ভয়ে। সেজন্য আমি আর মাধব বাবু কাজে ভাগ করে নিই। বাথরুমের ভেতরে কেউ গেলে বাইরে আরেকজন দরজা আগলে পাহারা দেবে। এই ভাবেই চালাচ্ছিলাম। বেশ চলছিলো। ঝ্যামেলা হলো, সেই বিশেষ দিনটায়।

অতো রাতে আর কেউ স্নান করতে আসবে না কথাটা ভেবে ! সুতরাং দুজন দুটো স্নানঘরে ঢুকে চটপট স্নান করতে ঢুকতেই পারা যায়। বাইরে দরজায় জাপানের কাঞ্জি হরফে কি যেন একটা লেখা আছে। মনে হলো মহিলা- পুরুষ বিভাগের কথা। “আরে রাখো তো, এতো রাত্তিরে আবার পুরুষ মহিলা! তাও আবার ‘কাঞ্জি’ হরফে লেখা!!” বীরের মতো ঢুকে পরলাম দুজনে দুই স্নানের ঘরে। জাপানে স্নানের ঘরকে বলে 'ওফুরো'। ওখানে স্নান করার জন্য পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে কতোগুলো আইন বা কায়দা আছে। স্লাইডিং দরজা ঘষ্টে খুলে প্রথম ঘরে এসে জামাকাপড়, চশমা, ঘড়ি স-ব সম্পূর্ণ খুলে দিগম্বর হয়ে একটা ঝুড়িতে রাখো। তারপর অনেক বড় তোয়ালে রাখা আছে। সেখান থেকে একটা নিয়ে পরের স্লাইডিং ডোর সড়িয়ে আসল স্নান ঘরে ঢুকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় তোয়ালেটা রাখো। সামনে গরম জল ভর্তি বাথ টাব, চৌবাচ্চা একটা আছে। আগেই তাতে ডুব দিও না। দেওয়ালে কল খুলে সেই জল নিয়ে গা ধুয়ে ফ্যালো। এবার ছোট ছোট টুল আছে, তাতে বসে গায়ে সাবান ঘষো। দাঁড়িয়ে সাবান মাখা বিপজ্জনক। ভেজা,পালিশ করা মেঝেতে পা হড়কে যেতে পারে। সেজন্যই বসে বসে ঘষে ঘষে...হঠাৎ...খশ-শ-শ আওয়াজ!!!!

…সামনের দরজা ঘষটানোর আওয়াজটা হলো না? তার সঙ্গে খিল খিল হাসি!!!।…ও মাগো, বাবা গো…মুখে সাবান মেখেছি বলে ঠিক মতো চোখ খুলতে পারছি না…পিট পিট করে দেখছি…এ কি রূপে দ্যাখা দিলি মা !!!!…তিন-তিনটে সাদা রঙের মা কালী !!! আমি ওদের কাছে তো বলির পাঁঠা।আমাকে ওরা পালবে, নাকি কুরবানী দেবে, নাকি খোদার খাসি বলে ছেড়ে দেবে জানিনা। জয়মা কালী বলে সাবান সমেত ঝাঁপ দিই ওই গরম জলের চৌবাচ্চায়। উরে ব্বাপ্, গরমের ছ্যাঁকা কাকে বলে।আর একটু হলে সেদ্ধ জুনিয়রের ঝোল হয়ে যাচ্ছিলাম। ওই তিনটে সাদা কালীর দয়াতেই বেঁচে গেলাম। ওরা আমায় জাপটে ধরে টেনে তোলে। আর তার সঙ্গে আবহ সঙ্গীত, খিল খিল হাসি। আমি সামনে একটা ছোটটো তোয়ালে পাই। কি ঢাকবো ? লজ্জা ? নাকি পরিচয় ? পরিচয়টাই তখন ঢাকবার মুখ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। তোয়ালেটা দিয়ে মুখ ঢেকে বেড়িয়ে আসি। জামা কাপড় কোনোমতে চপিয়ে বেড়ুতেই দেখি মাধব বাবুও বেড়িয়ে এলেন।টেনে ঘরে এনে সব বলি। উনি চিন্তা করে বললেন, “আমরা দলে মোট আঠেরো জন। এঁরা সকালে জামাকাপড়, চশমা,টুপি পরিহিত অবস্থায় থাকলে তোমায় কেউ চিনতে পারবে না।” পরের দিন সকালে, যা ভয় পেয়েছি তাই। আমি তো যতোটা পারি ঢাকাঢুকি দিয়ে বেরুবার ধান্ধায় ছিলাম। কিন্তু যেই না ঘর থেকে বেরিয়েছি, শুনি সেই খিল খিল হাসি। ফর্সা তিনটে মা কালী অন্য রূপ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সুন্দর কিমোনো পরিহিতা। সর্বাঙ্গ ঢাকা। এগিয়ে এসে বললেন, " প্রথম দিন থেকেই আমরা আপনার ফ্যান। আপনাকে না বলে একটা ছবি তুলে ছিলাম। এক কপি দিলাম। আমাদের সঙ্গে একটা ছবি তুলবেন ?"

—” ছবি ?? না !! এখন একদম না। পরে পরে, আজকে শরীর ভালো নেই” বলে পালিয়েছি।
ওই খিল খিল হাসির আওয়াজটা আমি তখন থেকেই, জাপানে গেলেই শুনতে পাই।

বিয়ের পর জয়শ্রীকে বলি। বলে, ওখানে আর একটা অ্যাটম বোম ফেলবো। হাসি বের করে দেবো। কাছে পাই না একবার।
তারপর জাপানে অ-নে-ক বার গেছি। কিন্তু উৎসুনোমিয়াতে আর কখনও যাইনি।

ওদের দেওয়া, আগের সেই লুকিয়ে তোলা ছবিটা এই লেখার সাথে এখানে ছাপলাম।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.