//////[প্রদীপের সঙ্গে আলাপ=প্রলাপ]\\\\
+++++++++++(পর্ব-০৪৫)+++++++++++++++
মঞ্চ-মায়াবী,জাদু-শিল্পী পি সি সরকার জুনিয়র
(Dr. Prodip Chandra Sorcar, M.Sc.,Ph.D.). কলকাতা, ১৪, ফেব্রুয়ারি, ২০২১। বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, কলেজ লাইফে উঠে অব্দি আমি আমার কোনো 'ইয়ে' জোটাতে পারিনি। অবচেতন মনের ইচ্ছেটা ভেতরে ভেতরে ষোল আনা টলটলে বহমান নদীর জলের মতো সবার অজান্তেই বইতো , কিন্তু ওপরের রূপটা জলাতঙ্কের ভৌতবিজ্ঞান রূপ মতো থাকতো, শক্ত জমাট বরফ হয়ে । পাথরের চেয়েও কঠিন। না, বাড়িতে ঠ্যাঙানি খাওয়ারও ভয়ে নয়। ভয়টা অন্য রকমের। কাউকেই জীবন-সঙ্গীনী ,মানে , মনের তালা খোলার মতো 'চাবি' বলে মনে হতো না। মনে হতো কমবয়সী মাষ্টারণী। আমার বুদ্ধি মাপতে আর ভুল ধরতে, মালা হাতে এসেছেন ।

বিয়ে করেই উনি আমায় পড়া ধরবেন। প্রাণখুলে যে একটু ভুল করবো, সে স্বাধীনতা উনি দেবেন না। বকবেন! একটা মেয়েকে বেশ লাগতো, কিন্তু তার বাবা, মা আর দাদাকে দেখে প্রেম চটকে যায়। মনে হতো , আতঙ্কবাদী পরিবার। মেয়েটার জন্য কষ্ট হয়, বোধহয় ভালোবেসেই ফেলেছিলো। পাড়ায় ওনার 'হাতের-পাঁচ', আরো দু-তিনজনকেও, ভালোবেসে স্টকে রেখে ছিলেন। তারাও পালাক্রমে আমায় বলেছিলেন ওই একই কথা। ওদেরকেও নাকি একই মরণ কামড়ে ভরা প্রেমপত্র পাঠিয়েছিলেন। হয়তো কপি পেস্ট। আমার অনুপ্রবেশে নাকি সবাই ইরেজ্ড্। ক্যানসেল।"ক্যাডা কইলো উনি ভ্যাজাল সরিষার-পরিবারের তৈল ? এক্কেবারে খাঁটি কাচ্চি ঘানি-পেষা, sorry sir তৈল। একলব্য তাঁর কাল্পনিক গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে তীরন্দাজি বিদ্যা শিক্ষালাভ করার সময় তাঁর জীবনে কোনও 'মেহবুবা'র আবির্ভাব এবং সান্নিধ্য পেয়ে ছিলেন কিনা জানিনা, তবে আমার ক্ষেত্রে তেমন কেউ ছিলেন না।

এটা একটা 'খামতি' বলে আমি এখন মানি এবং সেই ত্রুটি অকপটেই স্বীকার করছি। মনে সেকথা উঁকি দিলেই ভাবতাম, হবে, সবই হবে, তবে এখন নয়, পরে হবে। কায়মনোবাক্যে আমি তখন জাদুবিদ্যা অভ্যাসে ব্যস্ত ছিলাম। রেওয়াজী ম্যাজিক। ছোট খাটো জিনিষ নিয়ে আসর জমানোর ম্যাজিক । এতে প্রচুর ধৈর্য্য, অভ্যাসের প্রয়োজন হয়। প্রতিভার সঙ্গে দক্ষতার মেলবন্ধন। সেটা আমি কষ্ট করে, ভালোবেসে আয়ত্ব করি । কৌশলগুলো রপ্ত করে নিজের বশে আনি। ওগুলো আমার খুব প্রিয় অহঙ্কার ছিলো বলেই বোধহয় কাজকেই এতটা ভালোবেসেছি।

এদিক ওদিক তাকাই নি। 'মানবী প্রেম' করাও হয়ে ওঠেনি। আমি তখন শুধু ম্যাজিক আর লেখা পড়া নিয়ে মশগুল। এটাও সাধনা ওটাও সাধনা। অর্থাৎ বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে দু-দিক দিয়ে পূজো করা। এতে ধর্মমতের ন্যাকামী নেই, ছিলো কাল্পনিক দৈবের কাছে কর্মের উপাসনার একাগ্রতা। বুঝেছিলাম, বাবাকে কাছে না পেলেও আমাকে দিশা দেখাবেন এই কাল্পনিক দেবী বা তাঁকে দেখিয়ে দেখিয়েই আমি হাত পাকাবো, একলব্যের মতো। বাবা কিন্তু স--ব খেয়ালে রেখেছেন। একদিন দেখি, আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা 'ম্যাজিক টেবিল' উপহার (পুরস্কার ?) দিলেন। তাতে খুব সুন্দর, রূপোলী জরী দিয়ে ইংরিজীতে লেখা আমার নাম- ' Prodip SORCAR'. 'Prodip' নামটা খুব কায়দা করে italics স্টাইলের আর তারপর 'SORCAR' লেখাটা, Bold হরফে। আমি বুঝে নিই অন্তর্নিহিত অর্থটা। বাবা, প্রদীপকে, মানে এই আমাকে , শৌখীন জাদুকর হিসেবেই ভাবছেন । তবে SORCAR ঘরাণার অঙ্গ বলে মেনেছেন। মানলেও আমাকে উত্তরসূরী বা তাঁরই কনটিনিয়েশন বা "জুনিয়র" হিসেবে পরিচয় পেতে আরও সাধনা করতে বলছেন। প্রেম করার অবকাশ দিচ্ছেন না। তখন আমি বাবার অনুকরণে সেরোয়ানী পাগড়ী তো বটেই, বিদেশী, কিন্তু অন্য জগতের এক লড়াকু সৈন্যের রোম্যান্টিক, নগ্ন -শির পোষাক পড়ে বা সাধারণ এক কলেজ-স্টুডেণ্টের সাধারণ পোষাকেই ম্যাজিক দেখাতাম।

অন্যদের মতো অহেতুক টেইল-কোট আর সিল্ক-টপ, কালো টুপি পড়তাম না। ওটা আমার এই ভারতীয় চেহাড়ায় বেমানান হবে বলে মনে হয়। দর্শকদেরও সমর্থন পেয়েছি। তবে ওই 'লড়াকু'পোষাকটা বাদ দিয়েছি আমি বাবার দেহান্তের পর, তারই ইচ্ছা বা আদেশ অনুসারে। বাবার শূণ্যস্থানে শো দেখাচ্ছি, বাবার পোষাক তো পড়তেই হবে। আর কোনো কথা নেই। লক্ষ্মী আর সরস্বতীতে ভাব নেই। আমার সেই চেতনা জাগে, অনেক দিন পর, ওই 'টেবিল'টা উপহার হিসেবে পেয়ে। আরোও বেশী সময় ধরে বাবাকে স্টেজে সহযোগীতা করতে শুরু করলাম মঞ্চমায়ার উপস্থাপনা শিখতে। লক্ষ্মী পূজোর এই বিদ্যা-শিক্ষার কোনোও শেষ নেই। এভাবে বাবাকে বটগাছের মতো আঁকড়ে ধরলাম। আমি হয়ে গেলাম বাবার মূখ্য সহকারী। কিন্তু সে নাহয় হলো,

দলের সব্বার তো একটা মাইনে আছে, আমার তো তা নেই। পকেট সব সময়ই খালি। নিজেকে খাওয়াবো কি? তার সঙ্গে বৌ থাকলে, তাকেই বা খাওয়াবো কী ? সুতরাং বুঝলাম নিজের উপার্জন নিজেকেই করে নিতে হবে। এখন বুঝি, বাবা কায়দা করে আমায় অভাবে ফেলে, উপার্জন করার শিক্ষায় ব্রতী হতে বলছেন। কবিগুরুর ভাষায় সেটা সেই শিক্ষা , যাতে "ঘরে কড়ি আসে দুটো"! যা শিখলাম , তার সার কথা হলো, "হাত ঘোরালে নাড়ু দেবো" বললেই নাড়ু পাওয়া যায় না। হাতের খেলা, ছোটছোট ম্যাজিক দেখিয়েও তেমনি বেশি "নাড়ু" বা ভদ্র-পরিমান অর্থলাভ বা সম্ভ্রান্ত-মাত্রায় উপার্জন করা যায় না। মঞ্চমায়া, স্টেজের ম্যাজিকে টিকিট বিক্রি করে, সেটা সম্ভব। সুতরাং হাতের খেলার রেওয়াজ অনিবার্য কারনে বন্ধ হলো। তখন চলছে আমার জীবন-যুদ্ধে প্রস্তুতির এক যুগসন্ধিক্ষণ। অ্যাত্তো রেওয়াজ, অ্যাত্তো বিদ্যার সাধনা, সব -- উপার্জনের খাতিরে, ফেলে দিতে হবে !!?

Narrow গেজের রেলগাড়ি তুলে সেখানে broad গেজের রেলগাড়ি চালাতে হবে !! জাগতিক নীতির এই জটীল সমীকরণের সমাধান করতে, খুব মানসিক শূণ্যতায় ভুগেছিলাম। বুঝলাম, লড়তে হবে অন্যান্য বড়মাপের মনোরঞ্জনের উপায় গুলোর সঙ্গে। সোজা কথায়, সিনেমা, থিয়েটার, মিউজিক্যাল, ভ্যারাইটি শো, ইত্যাদি বেশি জন-চিত্তজয়ী সফল অনুষ্ঠান গুলোর সঙ্গে। ওরাই আমার আসল প্রতিদ্বন্দী। ওদের টপকাতে হবে। কিন্তু ওরা সেটা চাইবে না। এ লড়াই বাঁচার লড়াই! এ লড়াই জিততে হবে। এই প্রথম আমার জীবনে অর্ধাঙ্গিনীর অভাব আমি অনুভব করি। কল্পনার ভাগীদারের চাপা অভাব। যিনি এসে আমাকে পাণ্ডিত্য দেখাতে স্কেল হাতে পেটাতে তাড়া করবেন না। বরঞ্চ আমার মনের রামধনুতে আরো রং সংযোজন করবেন। হাত ধরাধরি করে, আনকোড়া, টাটকা বিশাল স্বপ্ন নিয়ে সফল করতে চাইবেন। দুজনেরই জীবনের কম্পাস একই উত্তরমুখী হবে। মহালয়ার দিন থেকেই বন্ধুরা সবাই ঠিক করলাম এবার পূজোয় নীরস কলকাতার প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে না ঘুড়ে, সবাই মিলে আমার হুড -খোলা জঙ্গা জীপটা করে সুন্দরবনে হারিয়ে যাবো। কারুর মানা শুনবো না। হ্যাঁ, আমার 'জঙ্গা' জীপের কথাটা তো বলা হয়নি। ও আমার প্রচণ্ড শক্তিশালী এক চার-চক্রযান বাহন। কে বললো ও নিষ্প্রাণ এক যণ্ত্র-দানব? ও জীবন্ত! ওর আবেগ আছে। ও আমার সঙ্গে কথা বলে, আমি ওর কোলে অনেক দিন ঘুমিয়েছি। ও আমায় প্রেম করতে সাহায্য করেছে, আড়াল এবং নিশ্চিন্তিও দিয়েছে। ভেঙ্গে-চূড়ে, তুবড়ে দিয়েছে কেউ বেশী পাঁয়তারা দেখালে।

কলেজ জীবনে, অনেক কষ্ট করে, জন্মদিন, ঘরোয়া আড্ডা , ইত্যাদি আসরে, এদিক-ওদিকে ছোট ছোট শো করে, কিছু টাকা মায়ের কাছে জমিয়েছিলাম। প্রায় পনের হাজার টাকা। ম্যাজিকের প্রয়োজনে কিছু টাকার দরকার হলেই মাকে বলতাম টাকা চাই। বাবার কাছে চাইতাম না। "নিজের টাকায় নিজে দাঁড়াবো" - এটাই ছিলো আদর্শ। মা, 'আমার' জমানো , ওই 'পনের হাজার টাকা ' থেকেই দিতেন। কিন্তু কি অদ্ভুত কাণ্ড! যতোই খরচ করি না কেন, ওই পনেরো হাজারটা কখনো কমতো না!!! আমি বরাবরই বেহিসাবী। খরচের হিসেব রাখতেন মা। টাকা নিয়ে যখনই জিজ্ঞেস করতাম, " কতো রইলো?" মা নির্বিবাদে বলতেন, "পনের হাজার" । সব সময়ই পনের হাজার। প্রথমে খেয়াল করিনি। কিন্তু পরে জেগে উঠি। আরে!!টাকাটা ফুরোয় না কেন? দেরী হলেও বুঝি, মা আমার 'অফুরন্ত পনের হাজার টাকা', ওই "ওয়াটার অফ ইণ্ডিয়া" ম্যাজিকটার মতোই করে দেখাচ্ছেন। টাকা খরচ হলেই মা সেটাকে পূর্ণ করে দেন। যেদিন সেটা আবিষ্কার করি, সেদিন মার কি হাসি, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমার কি কান্না! " মা,আমাকে বড়ো হতে দাও। অথবা অনন্তকালের জন্য আমার সঙ্গে থাকো। আমি যেন কখনও অভাবে না পড়ি।" মা আমার অ্যাকাউণ্টে সেই অফুরণ্ত পনেরো হাজার টাকা দিয়েই বাবার কাছে চলে গেছেন। যাকগে সে কথা। আমার বাহন জঙ্গা জীপের কথায় আসি। আইডিয়াটা পেয়েছিলাম হলিউডের "COME SEPTEMBER" নামের সিনেমাটা দেখে। সেখানে এক দঙ্গল হুজ্জুতিবাজ ছেলে ,একটা হুড খোলা জীপ গাড়ি চেপে খুব মজা করছিলো। তখন থেকেই শখ একটা জীপ গাড়ি চাই। কিনবো, যতো কষ্টই হোক। মিলিটারি ডিসপোজালের একটা জীপের সন্ধান পাই। এগারো হাজার টাকা। কিনলাম। সামনের কাঁচটা বুলেটাহত। সেটা দেখেই প্রেমে পড়ে যাই। ফোর হুইল, সিক্স সিলিণ্ডার, পেট্রল গাড়ি। ১২০ হর্স পাওয়ারের বলে শুনেছি। নিউট্র্যাল গিয়ার থাকলে, "একটা যাত্রী-ভর্তি ডবল্ ডেকার বাসকেও ঠেলে জায়গা করে নিতে পারে।" পরীক্ষা নিয়ে সফল হয়েছি।

সাব্বাস। জীপ গাড়ি হো তো এইসা। কার্বোরেটরে পেট্রল ওভার-ফ্লো করে। মাঝে মাঝে ঠেলে স্টার্ট করতে হয়। গাড়ি ভর্তি বন্ধুরা থাকলে অসুবিধা নেই। ঠেলে দেবে। মল্লিকবাজারের সেকেণ্ড হ্যাণ্ডের দোকান থেকে একটা পুরোণো আমলের বিকট 'উ-হু' আওয়াজ করা হর্ণ কিনে লাগিয়েছি। হঠাৎ করে সামনে লোক চলে এলে, চাপা দিয়ে মারা নয়,ওই বিকট হর্ণ বাজিয়ে চমকে দিয়ে হার্ট ফেল-ও করাতে পারে। সবাই জানে, ওটা আমার গাড়ি।সুতরাং পুলিশ হাসি মুখে টা টা করেন। ঠিক হলো, দূর্গাপূজার অষ্টমীর দিন আমরা বন্ধুরা বন্য হবার রাস্তা না চিনলেও সুন্দরবনে সুন্দর হতে যাবো। সেটা 1967-এর অক্টোবর মাস।

সকাল নয়টায় ঠিক হলো, একত্রিত হবো। সময়মতো সকাল হলো, কিন্তু বন্ধুদের পাত্তা নেই। জানলাম, ওরা যে-যার 'ইয়ে'কে নিয়ে কোথায় যেন গিয়েছে। কেউ জানেনা কোথায় কে কোন প্যাণ্ডেলে। যাচ্চলে। গোল্লায় না গেলেই হলো। ( To be continued as পর্ব-০৪৬)


Be First to Comment