ডঃ পি সি সরকার (জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী ও বিশিষ্ট লেখক। কলকাতা, ১৬, ডিসেম্বর, ২০২০। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমাদের এই ‘জুনিয়র পরিবার’ বেশ সাহসের সঙ্গে যখন শেকড় বিস্তার করছে তখন ইন্দ্রজাল ভবনের চারতলায় আমার নির্দিষ্ট ঘরটাকে ‘কোজি’ নয়, ক্যাম্প মনে হচ্ছিলো। বড় মেয়ে মানেকা তার অধিকার মতো প্রথম প্রথম তার মায়ের পাশে, এবং পরে তার ‘বেবী কটে’ থাকলেও ঘরটাকে মনে হচ্ছে একটা মেস-বাড়ি। আমি হয়েছি ঘর থেকে বিতাড়িত। কারণ, জয়শ্রীকে সাহায্য করতে ‘আয়া’ রাখতে হয়েছে। তিনি এসেই জল, দুধ গরম করবার জন্য, জামা কাপড় শুকোতে দেওয়া, অয়েল ক্লথ ঝোলাতে… ইত্যাদির জন্য জমি দখল করে নিয়েছেন। এক আকাশে দুটো সূর্য্য নট্ অ্যালাউড। বিশেষ করে যুবতী আয়ার ক্ষেত্রে তো সেটা কঠোরভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং হও রিফিউজি। একবার-দুবার নয়,। পর পর তিনবার। দিনে মেগাষ্টার আর রাতে ভেজা-বেড়াল, মিউ মিউ রিফিউজি। তবুও বেশ ছিলাম। মহাপুরুষরা বলেন, প্রেম খাঁটি হলে কণ্যা সন্তান জন্মায়, লক্ষ্মী ঘরে আনতে কণ্যা জন্মায় এবং বৌ যদি বাঁধন-ছাড়া সুন্দরী হয়, তাহলেও কণ্যা সন্তান হয়। আমি তিন সত্যি করে, তিনটেই যে সত্যি কথা, তার প্রমাণ দিয়েছি। আমার তিনটি মাত্র কণ্যে। আরও ভালোবেসে সংখ্যাটা বাড়াতে পারতাম, কিন্তু জয়শ্রী বললো, নমস্কার, ক্ষ্যামা দাও। ক্ষমা করে দিয়েছি।

কোথাও বেড়াতে গেলে স্বামী- স্ত্রী-তিন কণ্যে এবং দুই আয়াকে নিয়ে যেতে হয়। সুতরাং বড় গাড়ি দরকার। একটা এইট-সিলিণ্ডার ‘ইম্পালা’গাড়ি কিনেছিলাম। বৌ-এর আব্দার।আমিই চালাতাম, বিশাল গাড়ি। চালাতে খুব লজ্জা করতো। চারদিকের পরিবেশের সঙ্গে বেমানান। সবাই সপ্রশংস দৃষ্টিতে যে তাকাতেন, তার নয়। চোখ দিয়ে বাক্য দিয়ে অপমানিত করতেন। কিন্তু, আমার বৌ-বাচ্চারা কি দোষ করেছে? ওর স্বামী, বাবা সৎভাবে উপার্জন করে কিনেছেন। এতে দোষ কোথায়?
হঠাৎ দেখি, একজন রোগা-পাতলা, ধুতি-ফোতুয়া পরা বয়স্ক ব্যক্তি , চোখে গোল তারের মোটা কাঁচের চশমা , বগলে ছাতা, চুল খুব ছোট করে ছাঁটা, এদিক ওদিক তাকিয়ে রাস্তা পার হতে চেষ্টা করছেন, পারছেন না। ফুটপাথ থেকে একবার নামছেন আবার উঠে যাচ্ছেন।
আমি চট্ করে দূরেই গাড়ি দাঁড় করাই। পারলে লুকিয়ে ফেলি। জয়শ্রী বললো, “কি হলো? দাঁড়ালে কেন?” আমি বলি ”একটু অপেক্ষা করো, আসছি।”
আমি রাস্তা পার হয়ে ওপারে যাই। ঠিক চিনেছি। আমাদের স্কুলের পণ্ডিত-স্যার! গিয়ে বলি- ” ভালো আছেন স্যার?” বলেই প্রণাম করি, পায়ে হাত দিয়ে। ক্যানভাসের জুতো, ছেঁড়া।
স্যার চমকে ওঠেন। বলেন, “তুমি …মানে আপনি কে?”
আমি অবাক হয়ে বলি, ” আমাকে চিনতে পারছেন না স্যার !!? আমি প্রদীপ!!আপনার ছাত্র।
প্রায় দশবছর পড়েছি আপনার কাছে !!!”
– ” বাবা বয়স হয়েছে। চোখে কম দেখি। অনেক ছাত্র ছিলো তোমার এই প্রদীপ নামে…তা তুমি কোন প্রদীপ বাবা ?”
ততক্ষণে জয়শ্রী দেখি মানেকা কে নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি বললাম, “ইনি আমাদের স্কুলের পণ্ডিত-স্যার। প্রণাম করো।”
জয়শ্রী, মানেকা প্রণাম করতে যায়। স্যার বাধা দিয়ে বলেন, ” না, না, থাক্ থাক্…তোমরা কারা বাবা??!!”
-” স্যার, এ হচ্ছে আমার বৌ, জয়শ্রী, আর। এ আমার বড়ো মেয়ে…মানেকা”
– “কিন্তু তুমি কে ? কোন প্রদীপ ? অনেক প্রদীপ নামে ছাত্র ছিলো…তুমি কে ??”
-” স্যার্, আমি পি সি সরকারের ছেলে প্রদীপ।”
“অ্যাঁ … …তুমি পি সি সরকারের ছেলে প্রদীপ ?? …. তাই বলো, আমার এটা আগে বোঝা উচিত ছিল।
তুমি…তোমরা আলাদা রকম মানুষ।…তাই বলি… এই দিনের আলোয়….সবার সামনে আমাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো কে… আমাকে না, আজকাল কেউ প্রণাম ট্রণাম করে না।…”
স্যারের বগল থেকে ছাতাটা খসে পড়ে যায়।
আমাকে জড়িয়ে ধরে বেশ জোরে জোরে ফুঁপিয়ে কাঁদেন। আমিও কাঁদি। জয়শ্রী আমাদের সামাল দিতেও কেঁদে ফেলে।
মানেকা চোখ মুছে ছাতাটা তুলে হাত দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে ওনাকে দিয়ে বলে, “স্যার-দাদু, আপনার ছাতা।”

এর পর, অন্য কাহিনী। প্রতিশোধ নেওয়ার কাহিনী। আমরা তিন ভাই, মাসী এবং গৃহশিক্ষকের করুণ কাহিনী। তার ছবি দিলাম, কিন্তু লেখাটা পরে দেবো, অবশ্য যদি আপনারা চান।

Be First to Comment