বর্ধমান জেলার খাটুন্দি গ্রামের পুজো…..
অপর্ণা চ্যাটার্জি : বর্ধমান, ২৭, অক্টোবর, ২০২০। বর্ধমান সদর শহর থেকে উত্তরে ষাট কিলোমিটার গেলে পাঠক পৌঁছবেন খাটুন্দি গ্রাম, কেতুগ্রাম থানার অন্তর্গত। আর সব ব্যাপারে বঙ্গদেশের অনেক গ্রামের মতোই হওয়া সত্ত্বেও খাটুন্দি এক জায়গায় একেবারেই স্বকীয়। আনুমানিক ছ’শ বছর আগে এই গ্রামেরই বাসিন্দা ভট্টাচার্য পরিবারের আদিপুরুষ রামগোপাল ভট্টাচার্য শুরু করেন দেবী দুর্গার আরাধনা। রামগোপালের সন্তান কেশব ভারতী (পূর্বাশ্রমের নাম কেশব ভট্টাচার্য ) ছিলেন স্বয়ং শ্রীচৈতন্য দেবের দীক্ষাগুরু। পরে কেশব ভারতীর উত্তরপুরুষ নিশাপতি গ্রামেরই কৃষ্ণ রায়ের মন্দিরের পাশে নিয়ে আসেন এই পুজোটি। আর সেই সময় থেকে বৈষ্ণব আর শাক্ত মতের যে অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছিল ভট্টাচার্য বাড়ির পুজোয়, ঐতিহ্যের সেই ধারা আজও একই ভাবে বহমান। জনশ্রুতি আছে নিশাপতির তিন নাতি তিনটি পুজো শুরু করেন। পরে দৌহিত্র সূত্রে আরও চারটি পুজো শুরু হয়। তখন থেকে প্রায় একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে সাতটি পুজো হচ্ছে এখানে।

বর্তমানে সাতটি পুজোই সমান প্রাধান্য পায়। একই অঙ্গনের এক দিকে কৃষ্ণ রায়ের নাটমন্দির (কেষ্টরাই উঠোন) আর আরেক দিকে পাশাপাশি সাতটি পুজোর সহাবস্থান সত্যিই দর্শনীয় (পূর্ণাঙ্গ পুজো ছয়টি, সপ্তম পুজো নবমীর দিনে ঘটে সম্পন্ন হয়)। পরিবারের ছ’টি পুজোর সবকটিতেই প্রতিমার মধ্যে অনেক সাদৃশ্য দেখা যায়। বংশ পরম্পরায় এই পুজোর মূর্তি গড়ে আসছেন নেউল মিস্ত্রি এবং তাঁর উত্তরপুরুষরা। এর মধ্যে পাঁচটি পুজোয় শাক্ত মতে, ষোড়শ উপাচারে সপ্তমী থেকে নবমী দেবীর উদ্দেশ্যে ছাগল বলি দেওয়া হয়। পশুবলির আগে কৃষ্ণ রায়ের ভোগ সমাধা হলে তাঁকে কানে তুলো দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়। ষষ্ঠ পুজোটি কিন্তু সম্পূর্ণ বৈষ্ণব মতে হয়, কোনো রকম আমিষের নামগন্ধ ছাড়াই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এ’বছর সপ্তম পুজোটিও পূর্ণাঙ্গ রূপে হতে চলেছে। প্রতিপদের দিন ছ’টি পুজোর ঘট ঈশানী নদী থেকে ভরে এনে রাখা হয় কৃষ্ণ রায়ের মন্দিরে। সপ্তমীর দিন ভোরবেলা নবপত্রিকার স্নান করিয়ে আলাদা করে পুজোর ঘট এনে প্রতিটি মণ্ডপে রাখা হয়। আগে হয় রাধা কৃষ্ণের পুজো। পরিবারের প্রত্যেকের বাড়িতে রাধা কৃষ্ণকে নিয়ে গিয়ে অন্নভোগ দেওয়া হয়। আবার দশমীর সন্ধ্যায় সবকটি দেবীমূর্তিকে বসানো হয় কৃষ্ণ রায়ের সাথেই। এই পুজোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল সিঁদুর খেলা হয় দশমীর পরিবর্তে মহাষ্টমীতে। যে পঞ্চপ্রদীপ দিয়ে রাধা কৃষ্ণের আরতি হয় সেই পঞ্চপ্রদীপ দিয়েই বাড়ির বধুরা দেবী দুর্গাকে বরণ করেন।

এরপর সবার আগে বের হয় বয়োজ্যেষ্ঠর প্রতিমা, বয়ঃক্রমানুসারে একে একে নিরঞ্জন হয় প্রতিমাগুলির। প্রচারের আলোয় না থাকলেও, একই অঙ্গনে শ্যাম রাইকে সাক্ষী রেখে ছয় শরিকের এই একসাথে মিলেমিশে কয়েক শত বছর ধরে করে আসা পুজো ঐতিহ্যের বিচারে প্রায় এক পীঠস্থানই বলা যেতে পারে। অতিমারীর কারণে এইবছর এই পুজো পারিবারিক গণ্ডীতেই সীমাবদ্ধ থাকছে। তাই পাঠকের উদ্দেশে বলি, এ’বছর না হোক, আগামী বছরে দুর্গা পুজোর যে কোনো একটি দিনকে এই পুজো দেখার জন্য রাখতেই পারেন – জেলা বর্ধমান, থানা কেতুগ্রাম, গ্রাম খাটুন্দি।

Be First to Comment