Press "Enter" to skip to content

‘অযান্ত্রিক’ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন- ‘‘ঋত্বিক ঘটকের দ্বিতীয় ছবি ‘অযান্ত্রিক’ যারা দেখেছিলেন, তারা ঋত্বিকের অসামান্য বৈশিষ্ট ও মৌলিকতার পরিচয় পেয়ে চমৎকৃত হয়েছিলেন”….।

Spread the love

স্মরণ : ঋ ত্বি ক ঘ ট ক

বাবলু ভট্টাচার্য : সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মত্ত থাকা এক কিংবদন্তী শিল্পী ঋত্বিক ঘটক। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমকে তিনি ব্যবহার করেছেন তার জীবনকালে। রাষ্ট্র ও সমাজের তৈরি করা অদ্ভুত সব নিয়মনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষের আত্মার যন্ত্রণা তুলে এনেছেন তাঁর প্রতিটি লেখা ও চলচ্চিত্রে।

পুরো নাম ঋত্বিককুমার ঘটক। সমাজ সচেতন ও সংস্কৃতিমনা পরিবারের আবহে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার ঋষিকেশ দাশ লেনে তার জন্ম। বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, কবি ও নাট্যকার। মা ইন্দুবালা দেবী। বড়দা মণীষ ঘটক একজন অধ্যাপক, লেখক।

জন্ম ঢাকায় হলেও বাবার সরকারী চাকরিরসূত্রে ঘুরতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। হয়তো বিভিন্ন স্থানে বসবাস করার কারণেই মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন অনেক বেশি। তাই শৈশব থেকেই তার মননে দাগ কেটেছে সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা।

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগের মর্মবেদনা নিয়ে তাদের পরিবার কলকাতায় চলে যায়। জন্মস্থানের শেকড় ছিঁড়ে শরণার্থী হওয়ার মর্মবেদনা ঋত্বিক মৃত্যুর আগমুহূর্তেও ভুলতে পারেননি। এই বেদনা ঋত্বিকের জীবন দর্শন নির্মাণে প্রভাবিত করে।

ঋত্বিক ঘটকের লেখাপড়া শুরু হয় ময়মনসিংহের মিশন স্কুলে। পরবর্তীতে কলকাতার বালিগঞ্জ স্কুলে তিনি ভর্তি হন। ১৯৫৮ সালে তিনি বহরামপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু এম. এ. সম্পূর্ণ না করেই তিনি পত্রিকায় লেখালেখির সাথে যুক্ত হন।

মঞ্চ নাটককে তিনি প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বেছে নেন। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম নাটক লেখেন ‘কালো সায়র’। ১৯৫১ সালে ঋত্বিক ঘটক ভারতীয় গণনাট্য সংঘে (IPTA) যোগ দেন। তিনি অসংখ্য নাটক রচনা করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন এবং অভিনয়ও করেছেন।

১৯৫২ সালে তিনি ‘দলিল’ নাটক নির্মাণ করেন; নাটকটি Indian peoples theatre Association Exhibition- (মুম্বাই, ১৯৫৩) এ প্রথম পুরস্কার অর্জন করে। একই সালে তিনি ‘নাগরিক’ ছবি নির্মাণ করেন। যদিও সেটি তার জীবনদশায় মুক্তি পায় নি।

ঋত্বিকের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘অযান্ত্রিক’ মুক্তি পায় ১৯৫৮ সালে। সেসময় পুরো ভারত জুড়েই অন্যরকম আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ছবিটি। ‘অযান্ত্রিক’ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন- ‘‘ঋত্বিক ঘটকের দ্বিতীয় ছবি ‘অযান্ত্রিক’ যারা দেখেছিলেন, তারা ঋত্বিকের অসামান্য বৈশিষ্ট ও মৌলিকতার পরিচয় পেয়ে চমৎকৃত হয়েছিলেন।”

বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবার সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবেই তিনি সিনেমা জগতে এসেছিলেন। এর চেয়ে জোরালো মাধ্যম পেলে তাকেই তিনি মান্য করতেন, এমন দৃপ্ত ঘোষণা তিনি করেছেন তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায়- ‘আমরা যখন মাঠে ময়দানে নাটক করতাম, তখন চার-পাঁচ হাজার লোক জমা হতো, নাটক করে তাদের একসঙ্গে rouse করা যেত। তখন মনে হলো সিনেমার কথা, সিনেমা লাখ লাখ লোককে একসঙ্গে একেবারে মোচড় দিতে পারে। এই ভাবেই আমি সিনেমাতে এসেছি, সিনেমা করব বলে আসিনি।’

দেশভাগ তিনি কখনই মেনে নিতে পারেননি। এই যন্ত্রণা থেকে তিনি তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তিনি বলতেন- ‘বাংলা ভাগটাকে আমি কিছুতেই গ্রহণ করতে পারিনি– আজও পারিনা। ইতিহাসে যা হয়ে গেছে তা পাল্টানো ভীষণ মুশকিল, সেটা আমার কাজও নয়। সাংস্কৃতিক মিলনের পথে যে বাধা, যে ছেদ, যার মধ্যে রাজনীতি-অর্থনীতি সবই এসে পড়ে, সেটাই আমাকে প্রচন্ড ব্যথা দিয়েছিল’।

১৯৬৫ সালে স্বল্প সময়ের জন্য পুনেতে বসবাস করেন। সেসময় পুনের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দু’বছর কাজ করেছেন। একই প্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষ ছিলেন তিনি কিছুদিন।

ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মণি কাউল, কুমার সাহানি এবং প্রসিদ্ধ আলোকচিত্রী কে কে মহাজন তারই ছাত্র।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে তিনি তৈরি করেছিলেন ‘দূর্বার গতি পদ্মা’।

১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ঋত্বিকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। আত্ম-উপলব্ধি ও আত্মবিশ্লেষণের নির্মোহ শিল্পরূপ এই চলচ্চিত্র। আত্মজীবনীমূলক হলেও এটা ১৯৪৭-এর দেশভাগ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আর নকশালবাড়ি আন্দোলনের সমালোচনাও বলা যায়।

শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্ক আর গপ্পো’র পর পুরোপুরি বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন ঋত্বিক। জটিল সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়াই মাঝে মধ্যেই মারমুখি হয়ে উঠতে থাকেন। এই গুণী নির্মাতাকে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে হয়েছে হাসপাতালের নির্জন প্রকোষ্ঠে।

ঋত্বিক ঘটক ১৯৭৬ সালের আজকের দিনে (৬ ফেব্রুয়ারি) ৫০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

More from CinemaMore posts in Cinema »
More from EntertainmentMore posts in Entertainment »
More from InternationalMore posts in International »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.