জন্মদিনে স্মরণঃ শে ন ও য়া র্ন
বাবলু ভট্টাচার্য : বিশ্বের তাবড় ব্যাটাররা প্যাভেলিয়নে ফিরেছেন তাঁর ঘূর্ণির মুখে পড়ে। তাঁর লেগ-ব্রেক বারেবারেই ভেঙে দিয়েছে বিপক্ষের ব্যাটিং লাইন-আপ। বিশ্বের অন্যতম সেরা দলের সদস্য হিসেবে ক্রিকেটকে দিয়েছেন অনেককিছু। তিনি শেন ওয়ার্ন।
শেন ওয়ার্নের হাতে বল মানে, উইকেটের সামনে ব্যাট হাতে যিনিই দাঁড়িয়ে থাকুন না কেন, প্রকাশ্যে না হলেও মনে মনে সমীহ করতেই হত। দীর্ঘ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনে হাজারেরও বেশি উইকেট নিয়েছেন শেন।
তার মধ্যে শুধুমাত্র টেস্টেই নিয়েছেন ৭০৮টি উইকেট। একদিনের ক্রিকেটে তাঁর উইকেটের সংখ্যা ২৯৩। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইউকেট শিকারি অস্ট্রেলিয়ার এই স্পিন বোলার।
ক্রিকেটের পাশাপাশি শেন ওয়ার্নের ব্যক্তিগত জীবনও বারেবারে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আর তার নেপথ্যে অন্যতম কারণই ছিল বিতর্ক। ডোপ, নারী সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি বা প্রকাশ্যে বাক-বিতণ্ডা-সহ বিভিন্ন বিতর্কে নাম জড়িয়েছে তাঁর।
তাঁর বাবা ছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত। হ্যাম্পটন হাইস্কুলে গ্রেড সেভেন থেকে নাইন অবধি পড়াশোনা। এরপর মেনটোন গ্রামারে চলে যান স্পোর্টস স্কলারশিপ পেয়ে। স্কুলজীবনে শেষ তিন বছর কাটিয়েছেন মেনটোনে।
১৯৮৩-৮৪ মরশুমে ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে তৎকালীন ভিক্টোরিয়ান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের অনূর্ধ্ব ১৬ ডাউলিং শিল্ড প্রতিযোগিতায় খেলতে নামেন। লেগস্পিন ও অফস্পিনের মিশেল ঘটাতে পারতেন অবলীলায়, ব্যাটের হাতও ছিল ভালোই।
১৯৮৭ সালে ক্রিকেটের অফ-সিজনে অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবলও খেলেছেন শেন, সেন্ট কিলডা ফুটবল ক্লাবের অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে। তবে ১৯৮৮ সাল থেকে ফুটবল ভুলে ক্রিকেটেই মনঃসংযোগ করেন শেন ওয়ার্ন। ১৯৯০ সালে অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট আকাদেমিতে প্রশিক্ষণের সুযোগ আসে।
১৯৯১ সালে ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে অ্যাক্রিংটন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে পেশাদার ক্রিকেটে প্রবেশ। প্রথমদিকে ইংল্যান্ডের আবহাওয়ায় অসুবিধা হলেও মরশুমে ৭৩ উইকেট নেন। ব্যাট হাতে করেন ৩২৯। অলরাউন্ডার হিসেবে হতাশ করায় পরের মরশুমে ওয়ার্নকে রাখেনি অ্যাক্রিংটন।
১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়ার্নের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় ভিক্টোরিয়ার হয়ে, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। ওই বছরই সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়া বি দলের হয়ে জিম্বাবোয়ে সফরে যান। ওই সফরের দ্বিতীয় ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি ৪৯ রানে ৭ উইকেট নিয়ে চমকে দেন। অস্ট্রেলিয়া বি ৯ উইকেটে জেতে।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরেই ওয়ার্ন অস্ট্রেলিয়া এ দলের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৩ ও ৪ উইকেট নেন। অস্ট্রেলিয়া সফররত ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম দুটি টেস্টে পিটার টেলরের হতাশাজনক পারফরম্যান্স তৃতীয় টেস্টের প্রথম একাদশে ওয়ার্নের জায়গা সুনিশ্চিত করে দেয়।
সিডনিতে খেলেছিলেন অভিষেক টেস্ট, বিদায়ী টেস্ট ২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেই খেলেন সিডনিতে। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৫ অবধি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক খেলেছেন ওয়ার্ন। ২০১৩ সালে খেলেছেন শেষ টি ২০ ম্যাচ, বিগ ব্যাশে। আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালস দলের হয়েও খেলেছেন ওয়ার্ন।
২০০৩ সালের বিশ্বকাপের আগে ড্রাগ টেস্টে উত্তীর্ণ হতে না পারায় শেন ওয়ার্নকে নির্বাসিতও করা হয়েছিল। নির্বাসন কাটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরেন গলে, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টেস্টে তিনি কামব্যাক করেছিলেন।
১৯৯০-এর দশকে লেগস্পিনকে জনপ্রিয় করতে বিশাল অবদান রাখেন শেন ওয়ার্ন। তবে এই ওয়ার্নের বিরুদ্ধে শারজায় সচিনের মরুঝড় তোলা ক্রিকেটপ্রেমীরা মনে রাখবেন আজীবন। ওয়ার্নের বোলিং স্টাইল, বৈচিত্র্য পিছনে ফেলে পাকিস্তানের আবদুল কাদিরের জনপ্রিয়তাকে।
১৯৯৩ সালে অ্যাশেজ ওয়ার্নকে কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। ওয়ার্নের যে বল মাইক গ্যাটিংকে বোকা বানিয়ে উইকেট ভেঙে দিয়েছিল সেটিকে শতাব্দীর সেরা বল বলা হয়ে থাকে। ২০০৭ সালে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া-শ্রীলঙ্কা টেস্ট সিরিজ ওয়ার্ন-মুরলীধরন ট্রফি নামাঙ্কিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। মুথাইয়া মুরলীধরন ও রিচার্ড হ্যাডলির পর তিনিই সবচেয়ে বেশি পাঁচ উইকেট নিয়েছেন টেস্টে।
শেন ওয়ার্ন আইপিএলে ২০০৮ থেকে ২০১১ অবধি রাজস্থান রয়্যালসে খেলেছেন, মেন্টরের ভূমিকাও পালন করেছেন। আইপিএলে রাজস্থান তাঁর অধিনায়কত্বেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ২০১৮ সালেও রাজস্থান রয়্যালস ওয়ার্নকে মেন্টর হিসেবে নিযুক্ত করেছিল।
২০১৩ সালে তিনি আইসিসির ক্রিকেট হল অব ফেমে জায়গা করে নেন। তার আগের বছরই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট হল অব ফেমে রেখেছিল ওয়ার্নকে। তাঁর ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণও সমৃদ্ধ করতো ক্রিকেটবিশ্বকে। ভারতীয় দলের পারফরম্যান্সেরও অন্যতম প্রশংসক ছিলেন বিশ্লেষকের ভূমিকায়।
শেন ওয়ার্ন হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ২০২১ সালের ৪ মার্চ থাইল্যান্ডের কোহ সামুইয়ে মৃত্যু হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৫২ বছর।
শেন ওয়ার্ন ১৯৬৯ সালের আজকের দিনে (১৩ সেপ্টেম্বর) অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment