জন্মদিনে স্মরণঃ হীরালাল সেন
বাবলু ভট্টাচার্য : আত্মবিস্মৃত বাঙালির, বিস্মৃত এক নায়ক— হীরালাল সেন।
তিনি ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শক, নির্মাতা এবং সার্বিকভাবে প্রথম চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব।
তথ্য বলছে, ১৮৮৭-১৮৯৮ সালের মধ্যে ফোটোগ্রাফি চর্চায় শ্রেষ্ঠত্বের জন্য হীরালাল সাত বার স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। ভাই মতিলাল এবং দেবকীলালকে নিয়ে ঢাকা মানিকগঞ্জের আদিবাড়িতে স্টুডিয়ো খুলেছিলেন। সে যুগের বিচারে এই উদ্যোগ অবশ্যই চমকপ্রদ। হীরালাল তখন দেশের এক নম্বর স্টিল ফোটোগ্রাফার।
কিন্তু ফরমায়েশি ছবি তোলা আর কত দিন? অন্য স্বপ্ন ডানা মেলতে শুরু করেছে। ফোটোগ্রাফি থেকে বায়োস্কোপের নেশায় মাতলেন হীরালাল। ততদিনে ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে গিয়েছেন। স্টিল ফোটোগ্রাফির ব্যবসা ভুলে বায়োস্কোপ শিক্ষায় মাতলেন।
কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না। বায়োস্কোপে তখন সাহেবদের একচেটিয়া আধিপত্য। তখন স্টার থিয়েটারে স্টিফেন্স সাহেব বলে একজন বায়োস্কোপ দেখাতেন। থিয়েটারের ফাঁকেই তা দেখানো হত। সেই প্রথম চলমান ছবি চাক্ষুষ করলেন হীরালাল। কেমন যেন ঘোর লেগে গেল! এতদিন যে ছবি তুলেছেন, সেই সব সৃষ্টি মিথ্যে মনে হতে লাগল।
আই.এস.সি-র ছাত্র হীরালালের লেখাপড়ায় মোটেই ঝোঁক ছিল না। একদিন একটি পত্রিকায় সিনেম্যাটোগ্রাফ মেশিনের বিজ্ঞাপন দেখলেন। ব্যস, মা বিধুমুখী দেবীর কাছ আবদার জুড়লেন কিনে দেওয়ার জন্য। মায়ের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে যন্ত্রের অর্ডার দিয়ে দিলেন!
যে সময়টায় হীরালাল বায়োস্কোপের কারবার শুরু করলেন, তখন কলকাতার একেবারে অন্য রূপ। সাহিত্য-সংস্কৃতি সব দিকেই শিখরে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী। রাস্তায় ট্রাম চলছে। পাশ দিয়ে হেঁকে যাচ্ছে জুড়িগাড়ি।
শহরের নানা দৃশ্য ক্যাপচার করতে লাগলেন হীরালাল। দর্শক হাঁ করে গিলতে লাগলেন সেই সব চিত্র। বাড়তে লাগল পরিচিতি। আসতে লাগল অর্থ। কিন্তু হীরালাল ক্রমশ বুঝতে পারলেন, গতে বাঁধা ছবি দেখানোয় ক্রিয়েটিভিটি নেই। যদিও তিনি ততদিনে আলো, সম্পাদনা নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা শুরু করে দিয়েছেন। সিনেমার জন্য যে একটা গল্পের প্রয়োজন, তা বুঝতে পেরেছিলেন হীরালাল।
ওই সময়ে ক্লাসিকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘সীতারাম’ জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই নাটকের কিছু অংশ তুললেন হীরালাল। তার পরে ‘আলিবাবা’ নাটকের অংশও তুললেন তিনি। জানা যায়, ১৮৯৮ সালের ৪ এপ্রিল ক্লাসিকে প্রথম বায়োস্কোপ দেখান হীরালাল।
হীরালাল যা-ই করেছেন, পাশে পেয়েছেন তাঁর পরিবারকে। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবাদে টাকা-পয়সা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। বাবা চন্দ্রমোহন সেন ছিলেন ঢাকা শহরের নামজাদা উকিল। মা বিধুমখী পুত্রের ইচ্ছেয় সব সময়ে সায় দিয়েছেন। যখনই হীরালাল কিছু চেয়েছেন তাঁরা হাজির করেছেন সামনে। আর একজন হীরালালের সব ইচ্ছেতেই মদত দিতেন। তিনি পিতামহ গোকুলকৃষ্ণ।
যদিও সিনেমার এই আদিপুরুষ সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। তাঁর উত্তরসূরিরা এতটাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে, তেমন তথ্যও মেলে না।
বিজ্ঞাপনের ছবি তোলার ক্ষেত্রেও তাঁকে পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। সি.কে সেনের ‘জবাকুসুম কেশ তৈল’, বটকৃষ্ণ পালের ‘এডওয়ার্ডস এন্টিম্যালেরিয়া স্পেসিফিক’, ডব্লিউ মেজর অ্যান্ড কোম্পানির ‘সার্সাপেরিয়া’র বিজ্ঞাপন করেন।
রয়্যাল বায়োস্কোপ ভেঙে যাওয়ার শোক নিতে পারেননি হীরালাল। ততদিনে তাঁর শরীর ভেঙেছে। ভেঙেছে মনও। তত দিনে হীরালালকে ধরে নিয়েছে রাজব্যাধি— ক্যানসার।
নিদারুণ শোক ও অর্থকষ্টে কেটেছে তাঁর জীবনের শেষ চারটে বছর। অভাবের তাড়নায় নিজের দু’টি ক্যামেরা বন্ধকি রাখতে বাধ্য হন।
১৯১৭ সালের ২৯ অক্টোবর মারা গেলেন হীরালাল। সে বছরই মতিলালের রায় বাগান স্ট্রিটের বাড়িতে আগুন লাগে। সেখানে ছিল হীরালালের তোলা সব ছবির স্টক। সমস্ত ভস্মীভূত হয়ে যায়।
হীরালালা সেন ১৮৬৮ সালের আজকের দিনে (২ আগস্ট) মানিকগঞ্জের বগজুরি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment