Press "Enter" to skip to content

হিন্দু ধর্ম মতে কালী বা কালিকা হচ্ছেন শক্তির দেবী…।

Spread the love

ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ১৮ মে ২০২৫।
হিন্দু ধর্ম মতে কালী বা কালিকা হচ্ছেন শক্তির দেবী।সৃষ্টি , পরিবর্তন , স্থিতি ও ধ্বংসের কারন ৷আসুন একটু জেনে নিই ৷ কালো ঘনীভূত শক্তির প্রতীক ৷ সৃষ্টির আদিতে কোন রং ছিল না৷ তাই আদ্যাশক্তি কালী কালো ।কাল শব্দটির অর্থ সময় হতে পারে, মৃত্যু বোঝাতে পারে আবার এটা রং ও বোঝাতে পারে। কাল তথা কৃষ্ণবর্ণ, এর অর্থ হতে পারে মৃত্যুবোধক।কাল শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ কালী ৷আমরা বলি – ‘কাল’ এসে গেছে, মৃত্যুর সময় সমাসন্ন, মহাকাল এসে গেছে। মহাকালকে নিয়ন্ত্রণ করেন কালী ৷ হয়েছেন মহাকালী। তিনি কালকে কলন বা রচনা করেন ৷কালীর নাম কাল না হয়ে কালী হলো একারণে যে শিবের অপর নাম কাল, যা অনন্ত সময়কাল বোধক। কালী হচ্ছে কাল এর স্ত্রীলিঙ্গ বোধক।দশ মহাবিদ্যার প্রথম মা কালী ৷ মা কালী মা দুর্গা বা পার্বতীর সংহারী রূপ। ঊনবিংশ শতাব্দীর সংস্কৃত ভাষার বিখ্যাত অভিধান শব্দকল্পদ্রুম এ বলা হচ্ছে “কাল শিবহঃ তস্য পত্নতি কালী।” অর্থাৎ শিবই কাল বা কালবোধক। তাঁর পত্নী কালী। কালী হচ্ছেন মা দুর্গার বা পার্বতীর অপর ভয়াল রূপ। তিনি সময়ের, পরিবর্তনের, শক্তির, সংহারের দেবী। তিনি কৃষ্ণবর্ণা বা মেঘবর্ণা এবং ভয়ংকরা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ভয়ংকরেরও পূজা করি। তিনি অশুভ শক্তির বিনাশ করেন। তাঁর এই শক্তির পূজা আমাদের হিন্দু সমাজকে প্রভাবিত করেছে। বিশুদ্ধ শক্তি সঞ্চারিত করেছে, অন্তর শুদ্ধি দিয়েছে,।দুর্দিনের দুর্বলতায় সাহস দিয়েছে‌‌‌।আগেই বলেছি
সৃষ্টির আদিতে সবকিছু ছিল তমসায় ঢাকা তাই দেবীকে আমরা কালো দেখি ৷ আমরা অজ্ঞানীরা যেমন আকাশ ও সাগরকে নীল দেখি ৷ আসলে তা বর্ণহীন ৷কালো আপেক্ষিক ৷কাশ্যপ মুনি ও দনুর দুই অসুর পুত্র শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের জন্য দেবী পার্বতীর ক্রোধ থেকে দেবী কৌশিকী বা কমলিকা বা কালীর আর্বিভাব ৷ ক্রোধের প্রকাশ কালো ৷কাল মানে সময় ৷ তিনি সময়ের দেবী ৷অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সব কালকে কলন বা গ্রাস করেন মহাকাল বা শিব ৷আবার মহাকালকে নিয়ন্ত্রণ করেন কালিকা ৷শিব শব ৷ জীবনের ক্ষয় বা সমাপ্তির প্রতীক ৷ সবাই শিবের মধ্যে শায়িত ৷কালী হলেন কেবলা বা সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী বা বিদ্যা ৷ ও শিবা হলেন পরম মুক্তি ৷
বিশ্বের আদিবীজ হলেন ” কালী ” ৷ কালের উৎপত্তির আগে থেকে বিরাজিতা তিনি ৷ “কলয়ত্রি সর্বমেতং প্রলয়কালে ইতি কালী ” ৷সারা জগৎ সংসার প্রাণীকূলকে কলন করেন ও গ্রাস করেন মহাকালী ৷ তাই তিনি আদ্যাশক্তি বা আদ্যাকালী ৷
তিনি সগুণা আবার নির্গুণা ৷ যখন জগৎ সংসার প্রকাশ করেন তখন নিরাকারা আবার অসুর বধে ও আমাদের মা রূপে সাকারা ৷ যিনি আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কলন করেন ৷
অর্থাৎ , কামনাকে বশীভূত করেন ৷ তাই , তিনি
বিবসনা ৷তাঁর বীজমন্ত্র “ক্রীঁ” ৷ ক অক্ষরে কালী , র অক্ষরে ব্রহ্ম আর ঈ অক্ষর মহামায়া স্বরূপ নাদধ্বনি ৷ শরীরের দক্ষিণ
অঙ্গ কা , মধ্যভাগ লি আর বাঁ অঙ্গ সমূহ কা ৷কালিকা ৷ কালী নানা রূপে পূজিতা ৷ একেক সাধক ও তান্ত্রিক তাঁকে নিজের সাধনায় দেখেছেন ৷দশ মহাবিদ্যার প্রথম হলেন কালী ৷দক্ষিণাকালী আদ্যা , ভদ্রকালী দ্বিতীয়া , শ্মশানকালী তৃতীয়া , কালকালী চতুর্থী , পঞ্চমী গুহ্যকালী , ষষ্ঠী কামকলাকালী , সপ্তমী ধনকালী ,অষ্টমী সিদ্ধিকালী আর নবমী চন্ডীকালী ৷মূর্তিময় ভৈরব মহাকালের উপর দন্ডায়মানা ৷ আমরা দক্ষিণা , বামা , রক্ষা , শ্যামা নানারূপে তাঁর পূজা করি ৷ সারা বছর নানা সময়ে বিভিন্নরূপে তাঁর পূজা প্রচলিত ৷ তবে , দীপাবলীর দিনকেই আমরা কালী পূজা বলি ৷ মায়াতীতা কালী কোন পার্থিব গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নন ৷তাই তিনি বিবসনা ৷আসলে তাঁকে কোন কিছু দিয়ে আবৃত বা ঢাকা যায় না ৷বসন বাসনার প্রতীক ৷দেবী কালীর কেশ বা চুল মৃত্যুকে বোঝায় ৷তিনি যে মুক্তস্বভাবা ৷মুন্ডমালা জ্ঞান শক্তিকে বোঝায় ৷শব্দ ব্রহ্ম৷ তিনি তাঁর স্বরূপ ৷কন্ঠের ৫০ টি মুন্ডমালা সংস্কৃত বর্ণকে বোঝায় ৷শিবের ওপর কালী ৷ মহাদেব শবরূপ ৷ শিবের বুকে দাঁড়িয়ে তিনি মৃত্যুকে জয় করার উপায় দেখান ৷ দেবীর ত্রিনয়ন হলো চাঁদ , সূর্য ও অগ্নি ৷
যা দিয়ে তিনি ভূত , ভবিষ্যত ও বর্তমানকে প্রত্যক্ষ করেন ৷ আমাদের প্রকাশ্য ও গোপন কাজ তিনি সর্বদা লক্ষ্য করেন ৷আসলে আদ্যাশক্তি মায়ের ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই ত্রিকাল নিয়ন্ত্রিত হয় ৷
শাক্ত সৃষ্টিতত্ত্ব মতে এবং শাক্ত তান্ত্রিক বিশ্বাস মতে তিনিই পরম ব্রহ্ম। কালীকে এই সংহারী রূপের পরেও আমরা মাতা সম্বোধন করি। তিনি সন্তানের কল্যাণ চান তিনি মঙ্গলময়ী, তিনি কল্যাণী এটাই তাঁর প্রতি সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল আস্থা ও নির্যাস। অসুর রক্তস্নাত কোপাণ্বিতা এই দেবীর সংহারী মূর্তিকে কিছুটা নিবৃত্ত ও প্রশমিত করতে শিব তাঁর চলার পথে শুয়ে থাকলেন। দেবী পথ চলতে গিয়ে তাঁর স্বামী শিবকে পায়ে মাড়ালেন। এই পাদস্পৃষ্টতার লজ্জায় ও তার অনুশোচনায় মায়ের জিহ্বায় কামড় পড়লো।
কালীকে যদি, বলি কল্পনা তবে সেই কল্পনাও ধর্মে বর্ণিত হয়েছে বর্তমান বিজ্ঞানের ধারণার হাজার হাজার বছর আগে। একথা বিজ্ঞান প্রথমত স্বীকার করে যে, সৃষ্টির আদি যুগে অনন্ত ব্রহ্মান্ড – ছিল তমসায় আবৃত, অনন্ত সৃষ্টিতে তখনো আলো সৃষ্টি হয়নি। সূর্য , চাঁদ , তারা বা কোনও আলোকবর্তিকা তখনো ছিলনা । বিজ্ঞান মতে আলো সৃষ্টির আগে অন্ধকার ছিল। এ বর্ণনায় কান পেতে শুনলে আমরা দেখি কৃষ্ণবর্ণা মা কালী সেই যুগের প্রতিনিধিত্ব করছেন । সনাতন ধর্ম বিজ্ঞান সম্মত ৷ ধর্ম ও বিজ্ঞানের এখানে অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে । দ্বিতীয়তঃ বিগব্যাংগ্ তত্ত্ব মতে কাল বা সময় তখন সবে মাত্র সৃষ্টি হয়েছে, কাল বা সময় যখন সৃষ্টি হলো তথা যেদিন ভূমিষ্ঠ হলো, সেদিন নির্ধারিত হলো সেই কালেরও শেষ আছে। সংহার আছে। বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড-সৃষ্টি যখন হয়েছে সময় এলে তা ধ্বংসও হবে। তার লয়ও অবশ্যম্ভাবী। কালী এই সংহারের প্রতিভূ, তিনি কালের জীবন্তকালের সীমারেখার নির্ধারণকারী। তৃতীয়তঃ বিজ্ঞানীরা সৃষ্টির প্রথম যুগের মহাবিশ্বের যে বর্ণনা দেন তা ভয়াল ভীষণ তার মধ্যে সৃষ্টির চাইতে ধ্বংসই বেশী। প্রবল সংহারের মধ্য দিয়ে অনন্ত ব্রহ্মান্ডে-র সৃষ্টি। মা কালী সেই সংহারের প্রতিভূ তাইতো মা ভয়াল দর্শণা সংহারের দেবী। সৃষ্টির সেই ক্রমবিকাশের যুগেই মা কালী মা জগজ্জননী প্রবল সংহারের মধ্যে দিয়েই তাঁর সৃষ্টি ও তাঁর কল্যানময় রূপকে আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। কালীর দুটি হাতে খড়্গ ও মুন্ড সংহারের অন্য দুটি হাত বর ও অভয় মুদ্রায় কল্যাণ বোঝাচ্ছে ৷ মা কালী যুগপৎ কাল, কৃষ্ণবর্ণা এবং সংহারের দেবী। কিছুই ছিলনা, তখন দেবী ছিলেন। এই মাতৃপূজা মাতৃমুর্তি হিন্দুধর্মের আদিকথা। অথর্ববেদ এ কালীর উল্লেখ থাকলেও বিশেষ হিসেবে কত্থক গ্ৰাহ্য সূত্রে( ১৯.৭) প্রথমবার কালীর উল্লেখ ঘটে। কালী অগ্নিদেবের সাতটি জিহ্বার একটি নাম, অগ্নিদেব হচ্ছেন আগুনের ঋগ্বেদীয় দেবতা যার উপস্থিতি মুণ্ডুক উপনিষদে বর্তমান; তবে এখানে কালী বলতে দেবী কালীকেই উল্লেখ করা হয়েছে এটা নির্ণয় করা কঠিন। কালীর বর্তমান রূপের উপস্থিতি আমরা পাই মহাভারতের সুপ্তিকা পার্বণে, যেখানে তিনি কালরাত্রি হিসেবে অভিহিতা, যিনি পাণ্ডব সৈন্যদের স্বপ্নে দৃশ্যমান এবং পরে দ্রোণাচার্য পুত্র অশ্বথামা যখন তাদের আক্রমন করলেন তখন তিনি প্রকৃত স্বরূপে আবির্ভূতা। তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিহতদের আত্মা নিয়ে যান ৷ মহাদেবীর একটি শক্তি হিসেবে তিনি ষষ্ঠ শতাব্দীর ‘দেবী মাহাত্ম‍্যম’ এ প্রসিদ্ধ , এবং ‘রক্তবীজ’ নামক অসুরকে পরাভূতকারী দেবী হিসেবে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখিত । রক্তবীজকে নিশ্চিহ্ন করতে দেবী নরসিংহী, বৈষ্ণবী,কুমারী, মহেশ্বরী, ব্রাহ্মী,বরাহী,ঐন্দ্রী,চামুন্ডা বা কালী এই অষ্ট-মাতৃকা রূপে সংস্থিতা । দশম শতাব্দীর ‘কালিকাপুরানে’ পরম সত্য হিসেবে কালীকে স্তুতি করা হয় । তবে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র এক দেবী হিসেবে ষষ্ঠ শতাব্দীতে কালী প্রথম উল্লেখিত, এবং এ সকল গ্ৰন্থে তিনি বহির্বৃত্তে বা প্রান্তিক সীমায় বা যুদ্ধক্ষেত্রে স্থিতা বা দণ্ডায়মানা দেবী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি শিবের শক্তিরূপে চিহ্নিতা, এবং বিবিধ পুরাণে শিবের উপস্থিতির সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্তা। কালিকা পুরাণে তিনি ‘আদিশক্তি’৷ তিনি প্রকৃতির সীমার বাইরেও অধিষ্ঠাত্রী ‘পরাপ্রকৃতি’। ১৬৯৯ শকাব্দে( ১৭৭৭ খ্রীষ্টাব্দে) কাশীনাথ বিরচিত ‘শ্যামাসপর্যায় বিধিতে’ এ পূজার সর্বপ্রথম উল্লেখ লক্ষনীয়। পূজার প্রমাণস্বরূপ এ গ্ৰন্থে পুরাণ ও তন্ত্রের বচন উল্লেখিত। সপ্তদশ শতাব্দীতে বলরাম বিরচিত কালিকা মঙ্গলকাব্যে একটি বাৎসরিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান কালীকে নিবেদিত মর্মে উল্লেখিত।
নবদ্বীপের শাক্ত সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বপ্ন অনুযায়ী সকালে ঘুম থেকে উঠে গোয়াল বধুর ঘুঁটে দেওয়ার দৃশ্য দেখে ৷ আর কৃষ্ণানন্দকে দেখে লজ্জায় ঐ বধূ লজ্জায় জিভ বের করেন ৷ সেই দেখে সাধক মৃন্ময়ী দক্ষিণা কালী প্রতিমা তৈরী করেন ৷ আজও নবদ্বীপ আগমেশ্বরী পাড়ায় তাঁর ঐ পুজো হয় ৷ ওটাই বাংলার প্রথম মাটির কালী প্রতিমা ৷ তার আগে তাম্রটাটে দেবীর পূজা হত ৷ অষ্টাদশ শতাব্দীতে নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বাংলায় প্রথম কালীপূজার প্রবর্তন করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কালীপূজা বাংলায় বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র এবং কোলকাতার সমাজের বিত্তবান ও উচ্চশ্রেনীর লোকজনের মধ্যে এ পুজোর প্রচলন বৃদ্ধি পায়। ক্রমে দুর্গাপূজার সাথে সাথে কালীপূজাও বিশেষত বাংলায় একটি প্রধান হিন্দু ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়।
শিবের উপর দন্ডায়মানা কেন তার তিনটি ব্যাখ্যা পাই ৷ এর একটি প্রচলিত কাহিনী ,একটি পৌরাণিক, অন্যটি তান্ত্রিক ব্যাখ্যা ৷ এটা বলা হয়ে থাকে যে শক্তি ছাড়া শিব হচ্ছে শব। শিবের উপর দন্ডায়মানা কালী এটাই বোঝায় যে শক্তি বাদ দিলে বস্তু মৃতমাত্র। পৌরাণিক ব্যাখ্যা মতে, পার্বতী একদিন স্বামীকে প্রশ্ন করলেন তার দশটি রূপের মধ্যে কোনটি শিবের পছন্দ? বিস্মৃত পার্বতী শুনলেন, কালীর ভয়াল মূর্ত্তিতেই শিবের স্বাছন্দ্য ৷ এই ধারণাটি দেবী ভাগবত পুরাণে ব্যাখ্যাত। দ্বাদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর ভক্তিমূলক শ্যামাসংগীতেও মায়ের বর্তমান রূপের এই ধারণাটি গুরুত্ব পেয়েছে। তান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাঁর ভয়াল রূপ সত্ত্বেও রাতদুপুরে শ্মশানে তাঁর মুখোমুখি হওয়ার সাহস অর্জন এবং অন্যদিকে তাঁর প্রতি হিন্দু বাঙালির শিশুর মতো শর্তহীন ভালবাসা উভয়ক্ষেত্রে মৃত্যুর সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও তাকে মেনে নেওয়াই প্রধান ৷
দুর্গার মত কালীও সাধারণ সর্বজনীন হিসেবে বিবেচিত। সবচেয়ে সরাসরি বহুলভাবে তিনি পূজিতা হন মহাকালী বা ভদ্রকালী রূপে। আদি পরাপ্রকৃতি( দেবী দুর্গা ) অথবা ভাগ্যবতীর দশমহাবিদ্যা রূপের একটি রূপে কালী পূজিতা হন। দেবী বন্দনার এই স্তোত্রকে বলা হয় দেবী অর্গলা স্তোত্রম যা নিম্নরূপ
“ওঁ সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বাত্ব সাধিকে স্মরণ্যে স্ত্রম্বকে গৌরী নারায়ণী নমোহস্তুতে।
ওঁ জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী
দুর্গা ক্ষমা শিবা ধাত্রী স্বাহা সদা নমোহস্তুতে।”
মধ্যযুগের শেষের দিকে বাঙালীর ভক্তিমূলক সাহিত্যে কালী ব্যপক স্থান নিয়ে বিরাজমান।
সাধক রামপ্রসাদ সেন ( ১৭১৮ – ১৭৭৫) এর মতো কালীভক্ত উপাসকরা কালীকে নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য ভক্তিমূলক গান। অথচ শিবপত্নী হিসেবে পার্বতীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে নানা কাহিনীতে উচ্চারিত হওয়া ছাড়াও অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে বাঙালির ঘরে ঘরে আবাহনী গেয়ে পূজিত হতে কদাচিৎ দেখা গেছে। আর বাঙালির ঘরে তাঁর ভয়াল রূপের বর্ণনা, বৈশিষ্ট্য, অভ্যাসসমুহে উল্লেখযোগ্য কোন রূপান্তর ঘটেনি।স্বামী বিবেকানন্দ “মৃত্যুরূপা কালী ” নামে এবং তাঁর শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা “মাতৃরূপা কালী ” নামে একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ লিখেছিলেন ৷ বাংলায় অনেক কালীমন্দির আছে । এর অনেক গুলোই সুপ্রাচীন। কালীঘাট , দক্ষিণেশ্বর ও আদ্যামা ,তারাপীঠ ,বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা ,কালনা সিদ্ধেশ্বরী , কাটোয়ার খেপি মা , ক্যানিং এর গৌড়দহ কালী , শান্তিনিকেতনের কংকালীতলা , হালিশহরের রামপ্রসাদী কালী , তমলুকের বর্গভীমা, আকালীপুরের গুহ্যকালী , ভবানী পাঠকের কালী প্রভৃতি বিখ্যাত এবং ঢাকার রমনা কালীমন্দির তেমনি একটি পুরাতন কালী মন্দির( যদিও পাক সেনারা আদি মন্দির ভেঙ্গে দিয়েছিল ) ব্রহ্মযামলে উল্লেখ আছে ‘কালিকা বঙ্গদেশে চ’ অর্থাৎ বঙ্গদেশে দেবী কালিকা বা কালী নামে পূজিতা হন। নানা রূপে, নানা স্থানে কালী পূজিতা হন, যেমন দক্ষিণা কালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী,মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি নামে মাহাত্ম্যে এ কালীর মধ্যে কিছু কিছু ভিন্নতা বর্তমান। আমরা নিজ গৃহে ফলহারিণী কালীপুজো করি প্রতিবছর জ্যৈষ্ট অমাবস্যায় দিনের বেলায় ৷ এবারে হবে ৬ জুন বৃহস্পতিবার সকালে ৷মা কালীকে বিভিন্ন মন্দিরে দশমহাবিদ্যা ব্রহ্মময়ী, ভবতারিণী, আনন্দময়ী, করুণাময়ী ইত্যাদি নামে কালীর পূজা হয়‌ । চট্টগ্রাম শহরের চট্টেশ্বরী, শ্রী কালীবাড়ী, গোলপাহাড় শ্মশান কালীবাড়ী, দেওয়ান হাটের দেওয়ানেশ্বরী কালীবাড়ী, সদরঘাট কালীবাড়ী, পটিয়া পিঙ্গলা কালীবাড়ী, ধলঘাট বূড়াকালী বাড়ী সহ চট্টগ্ৰামে অনেক প্রসিদ্ধ কালী মন্দির বর্তমান‌। এর প্রায় প্রত্যেকটিতে প্রত্যেক শনি ও মঙ্গলবার এবং অমাবস্যায় কালীপূজা হয়।
সর্বজনীন মণ্ডপে যেখানে দুর্গাপুজা হয় সেখানে অধিকাংশ মণ্ডপে কালীপূজাও হয়ে থাকে। অনেক কালীসাধক বিখ্যাত এবং শ্রদ্ধার্হ। শ্রীরামকৃষ্ণ কালীর উপাসক ছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ ও কালীর ভক্ত ছিলেন। কালী প্রশস্তিমূলক গান তথা শ্যামাসঙ্গীত বাংলা গানের একটি ভিন্ন ধারা। কালী সাধক রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য এ ধারায় অন্যতম অবদান রাখেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং কাজী নজরুল ইসলাম ও এ ধারায় উৎকৃষ্ট মানের গান রেখে গেছেন। বেশী লেখাপড়া না করেও শ্রীরামকৃষ্ণ দেবী কালী সচেতনতায় সিক্ত হয়ে অনবদ্য বাণী উচ্চারণ করতেন যা শ্রীম রচিত অমর গ্ৰন্থ ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ তে স্থান পেয়েছে। আমার লেখা দুটি ধর্মীয় গ্রন্থ ” সনাতনী কষ্টিকথা ” আর “হিন্দু ধর্ম” দুটিতেই সনাতন হিন্দু ধর্মের এমন বিভিন্ন দেবদেবী , পূজা পদ্ধতি সহ সবিস্তারে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি ৷ “মন” বইয়ে মানব মনের আঁকিবুঁকি এবং “রোগ পরিচয় ” বইয়ে শরীরের নানা অসুখ ও তার প্রতিকার এবং “অন্তর্দৃষ্টি” বইতে বাঙালি মনীষার বহুমাত্রিক দর্শন তুলে ধরেছি ৷ আমার লেখা পাঁচটি বইই ক্যুরিয়ারে ঘরে বসে বই পেয়ে যাবেন ৷ হোয়াটস এপে নিজের ঠিকানা দেবেন ৷ বইয়ের দোকানেও পাবেন ৷ মা কালীর পঞ্চাক্ষর মন্ত্র -” ওঁ হ্রিং স্ত্রিং হুঁ ফট্ ” ৷” কালরাত্রির্মহারাত্রিশ্চ দারুণা ৷
ত্বং শ্রীত্বমীশ্বরী ত্বং হ্রীস্ত্বং বুদ্ধির্বোধলক্ষণা ৷তিনি
সত্ত্ব ,রজঃ ও তমঃ পরিণামবিধায়িনী ৷ তন্ত্রে পাশ হল বন্ধন ৷ শরীর ঢাকার কাপড় নয় ৷ সূক্ষ্ম শরীর
ঢেকে রাখে বিভিন্ন পাশ ৷ কারী পাশ দিয়ে আমাদের ঢেকে রাখেন ৷ সাধকদের আরাধনা পাশ মুক্ত হওয়ার ৷ আত্মাকে পাশ দিয়ে না ঢেকে আমাদের কুন্ডলিনী শক্তিকে জাগাতে পারলে আমরা নাম ,যশ , অর্থ , খ্যাতি ,ঈর্ষা থেকে দূরে রাখতে পারবো ৷ পাশ মুক্ত বলে মা দিগম্বরী বা বিবসনা ৷ নিজের দর্শন , শ্রবণ , ঘ্রাণ , কাম থেকে বাকশক্তিকে বিবাসনা করাই সাধনার লক্ষ্য ৷ মায়ের এক পা অতীতে তাই অলীঢ়পাদা অন্য পা টি ভবিষ্যতে তাই প্রত্যালীঢ়পাদা ৷ খেচর মানে আকাশচারী ৷ মায়ের জিভ তাই খেচরী মুদ্রায় থাকে ৷ শূন্য ভাসমান দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে তাঁর জিভ ৷ জীবনের রহস্য রয়েছে মৃত্যুর মধ্যে ৷ যমের শক্তি তাঁর চুলে বলে তিনি মুক্তকেশী ৷ দীপাবলী বা দীপান্বিতা বা আশ্বিনী অমাবস্যায় অনুষ্ঠিত কালীপূজা উপলক্ষে দেবী মূর্তির দক্ষিণা কালীর অবয়বে তৈরী হয়, এক্ষেত্রে দেবীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দেবী করালবদনা, কৃষ্ণবর্ণা, নীলবর্ণা বা মহামেঘবর্ণা। দেবী আলুলায়িত কেশ। রামপ্রসাদী গানে ভক্তিভরে মাকে বলা হয়েছে , ‘…. এলোকেশী সর্বনাশী……, “মা এলোকেশী, রক্তচক্ষু, লোলজিহ্বা, চতুর্ভূজা, নৃমুন্ড-মালিনী, নর হস্তের কোমর বন্ধ, বাম করযুগলে উন্মুক্ত খড়্গ এবং নরমুণ্ড, ডান করদ্বয়ে বর ও অভয়মুদ্রা। দক্ষিণা কালীর দক্ষিণ পা শিবদেহে স্পর্শমান, বাম পা খানিকটা দুরত্বে। স্বামীর গায়ে পা পড়ায় অসুর – রক্ত পানে সিক্ত জিহ্বায় কামড়। ত্রিনয়নী মা অসুর হত্যার মহাঘোরে হাস্যরতা ও ভয়াল দর্শন । মায়ের গলায় নৃমুণ্ড মালায় সাধারণত ১০৮টি অথবা ৫১টি নরমুণ্ড বর্তমান‌। ১০৮হিন্দুদের জন্য একটি পবিত্র সংখ্যা, মন্ত্রপাঠের সময় গোনার জন্য জপমালায় ১০৮টি গুঠিকা থাকে। দেবনাগরী বর্ণমালায় সর্বসমেত ৫১টি বর্ণ আছে। হিন্দুদের বিশ্বাস সংস্কৃত একটি চলমান জীবন্ত ভাষা এবং এর ৫১ টি বর্ণমালায় অপার শক্তি নিহিত রয়েছে।
মায়ের কোন চিরস্থায়ী গুণ বা প্রকৃতি নেই, যার মানে দাড়ায় বিশ্ব-প্রকৃতি ধ্বংসের পরেও তিনি বর্তমান থাকবেন । তিনি মায়াতীতা ৷ আমরা মনে করি -মা দীন ও দয়াময়ী , দুখহরা ৷ মা তুমি সন্ধ্যা , তুমি গায়ত্রী , তুমি জগদ্ধাত্রী , অকুলের ত্রাণকর্ত্রী ৷
আমার মা ত্বং হি তারা ৷

More from CultureMore posts in Culture »
More from InternationalMore posts in International »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.