Press "Enter" to skip to content

হাজি আলি মোহাম্মাদের সন্তান রফির ডাকনাম ছিল ‘ফিকু’। ফকিরদের গান শুনে ছোটবেলাতে সুরের মায়ায় মন ভরে যায় তার। ১৯৪৪ সালেই প্রথম বারের মতো নওশাদের সংগীত পরিচালনায় গান করেন রফি………..।

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ মোহাম্মদ রফি

বাবলু ভট্টাচার্য : গ্রিক পুরাণের সেরা গায়ক ছিলেন দেবতা অ্যাপোলোর বরপুত্র অর্ফিউস। তিনি যখন তার বীণা বাজিয়ে গান গাইতেন তখন সাগর, নদী, পাহাড় এবং দেব-দানব সকলেই তন্ময় হয়ে শুনতেন। তার অপূর্ব সুরের মায়ায় দেবরাজ জিউসও মুগ্ধ হতেন। অর্ফিউস যদি একালে জন্মাতেন এবং বলিউডের সিনেমায় গান গাইতেন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি হতেন মোহাম্মাদ রফি।

‘বাহারো ফুল বরসাও’, ‘ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল’, ‘গুলাবি আঁখে’– এমনি কত সহস্র গান, কত সুপারহিট ছবি। মোহম্মাদ রফির কণ্ঠে গান মানেই তো সেটি শ্রোতার হৃদয়ে স্থান পাবে। কিংবদন্তি এই প্লেব্যাক গায়ক প্রায় ২৮ হাজার গান গেয়েছিলেন। হিন্দি ছাড়াও বাংলা, অহমিয়া,কোনকানি, ভোজপুরি, উড়িয়া, পাঞ্জাবি, মারাঠি, সিন্ধি, কন্নাড়া, গুজরাটি, তেলেগু, মাগাহি, মৈথিলি, উর্দু ইত্যাদি ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি। ইংরেজি, ফার্সি, স্প্যানিশ এং ডাচ ভাষাতেও গান করেছেন।

অমৃতসরের কাছে একটি ছোট গ্রাম কোটলা সুলতান সিং। সে গ্রামের বাসিন্দা হাজি আলি মোহাম্মাদের সন্তান রফির ডাকনাম ছিল ‘ফিকু’। গ্রামের ফকিরদের গান শুনে ছোটবেলাতে সুরের মায়ায় মন ভরে যায় তার। ১৯৩৫ সালে পরিবারের সকলকে নিয়ে লাহোরে চলে আসেন রফির বাবা।

রফির বড় ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন আবদুল হামিদ নামে এক সহৃদয় তরুণ। কিশোর রফির গান তাকে আলোড়িত করে। তার অনুপ্রেরণাতেই গান শিখতে শুরু করেন তিনি। ওস্তাদ আবদুল ওয়াহিদ খান, পণ্ডিত জীবন লাল মাট্টু এবং ফিরোজ নিজামির কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নেন রাফি।

অল ইন্ডিয়া রেডিও লাহোরে গান গাওয়ার সুযোগ পান তিনি। পাঞ্জাবি ছবিতে গান গাওয়ারও সুযোগ হয়। আবদুল হামিদ পরিবারের সবাইকে বোঝান যে রফির মুম্বাই যাওয়া উচিত। তিনি নিজেই রফিকে সঙ্গে করে ১৯৪৪ সালে মুম্বাই আসেন। চলচ্চিত্র জগতে চেনা-জানাদের সাহায্যে রফিকে সুযোগ দেয়ানোর চেষ্টা করেন তিনি।

কবি তানভির নাকভি রফিকে কয়েকজন নাম করা প্রযোজকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।

সেই সূত্রে পরিচয় হয় সংগীত পরিচালকে শ্যাম সুন্দরের সঙ্গে। ‘গাঁও কি গৌরী’ ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ হয়। সে সময়কার বিখ্যাত গায়ক জি এম দুররানির সঙ্গে হিন্দি সিনেমার জন্য প্রথম গান গাইলেন রফি। গানটি ছিল ‘আজি দিল হো কাবু মে’। ১৯৪৪ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। এর পর ধীরে ধীরে আরও বেশ কটি ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পান তিনি।

১৯৪৪ সালেই প্রথম বারের মতো নওশাদের সংগীত পরিচালনায় গান করেন রফি। ‘পাহেলে আপ’ ছবির জন্য ‘হিন্দুস্থান কে হাম হায়’ গানটি গান তিনি। আর এর মাধ্যমেই শুরু হয় নওশাদ-রফির পথচলা। এই জুটি উপহার দিয়েছেন অসাধারণ সব গান।

‘লায়লা মজনু’, ‘শাহজাহান’, ‘জুগনু’, ‘কাশ্মির কি কলি’— একের পর এক ছবিতে গান করেন রফি। কে এল সায়গল, নূরজাহানের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের সঙ্গে সে সময় গান করেছেন তিনি।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মুম্বাইতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরিবারের সবাইকে তিনি নিয়ে আসেন ভারতে। কিন্তু তার স্ত্রী কিছুতেই ভারতে আসতে রাজি হন না। কারণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তিনি হারিয়েছিলেন বাবা-মাকে। এইভাবে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে রফির।

১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর শোকাহত ভারতবাসীর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে একটি রেকর্ড বের হয়। হুসনলাল ভগতরাম-মোহাম্মাদ রফি-রাজেন্দ্রকৃষ্ণার মিলিত প্রয়াসে এই রেকর্ডে গাওয়া হয় ‘সুনো সুনো অ্যায় দুনিয়াওয়ালো বাপুজিকি অমর কাহানি’। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তার বাসভবনে গানটি গেয়ে শোনাতে রফিকে আমন্ত্রণ জানান। সে বছর ভারতের স্বাধীনতা দিবসে জওহরলাল নেহরু রূপার পদক উপহার দেন রফিকে।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বলিউডে রফি ছিলেন ব্যস্ততম প্লেব্যাক গায়ক। সে সময়ের নামকরা সংগীত পরিচালক নওশাদ, ওপি নায়ার, শংকর জয়কিষণ, শচীন দেব বর্মণ, মদন মোহন, রওশান— এদের সকলের সুরেই গান করেছেন রফি। বিশেষ করে নওশাদের সুরে গান গেয়ে রফি হয়ে ওঠেন সংগীতের আকাশে উজ্জ্বলতম তারকা। নওশাদের সুরে প্রায় ১৪৯টি গান করেন রফি।

১৯৫২ তে মুক্তি পায় ‘বৈজু বাওরা’। ভারত ভূষণ অভিনীত ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্যে ইতিহাস সৃষ্টি করে। এর সংগীত পরিচালক ছিলেন নওশাদ। আর এ ছবিতেই জীবনের শ্রেষ্ঠ গানটি করেন রাফি। ‘ও দুনিয়াকে রাখোয়ালে’ গানটিকে বলা হয় রফির প্রতিভার সেরা স্বাক্ষর।

১৯৬০ সালে ‘মোঘল এ আজম’ ছবিতে নওশাদের পরিচালনায় ১০০ শিল্পীর সঙ্গে কোরাসে রফি গান ‘আয়ে মোহাব্বাত জিন্দাবাদ’।

১৯৬০ সালেই মুক্তি পায় ‘চৌধভিন কা চান্দ’। ছবিটির সংগীত পরিচালক ছিলেন রাভি। এ ছবির ‘চৌধভিন কা চান্দ হো ইয়া আফতাব হো’ গানটি গেয়ে প্রথমবারের মতো ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে সেরা গায়কের পুরস্কার ঝুলিতে ভরেন রাফি।

গুরু দত্তর অনেক ছবিতেই গান গেয়েছেন রফি। সংগীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণ সে সময় গুরু দত্ত এবং দেবানন্দর প্লেব্যাক হিসেবে রফিকে ব্যবহার করতেন। মোহাম্মদ রফির একটা বিশেষ গুণ ছিল তিনি অন্যের কণ্ঠস্বর নকল করতে পারতেন। ফলে তিনি যে অভিনেতার জন্য প্লেব্যাক করতেন তার মতো কণ্ঠস্বরে গানটি গাইতে পারতেন। এজন্য প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে দিলিপ কুমার, দেবানন্দ, রাজকাপুরসহ সেরা সব নায়কদের জন্য গান করে তুমুল জনপ্রিয়তা পান তিনি। ‘পিয়াসা’, ‘কাগজ কি ফুল’, ‘কালা বাজার’, ‘কালা পানি’, ‘গাইড’- এর মতো সুপারহিট সব ছবিতে এস ডি বর্মণের সুরে গান গেয়েছেন তিনি। ষাটের দশকে লতা মঙ্গেশকারের সঙ্গে রফির ডুয়েট দারুণ জনপ্রিয় হয়।

শংকর-জয়কিষণ জুটির পরিচালনায় অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দেন রফি। ষাটের দশকে শাম্মী কাপুর ও ‘জুবিলি হিরো’ নামে খ্যাত রাজেন্দ্র কুমারের জন্য শংকর –জয়কিষণের সুরে তুমুল জনপ্রিয় সব গানে প্লেব্যাক করেন তিনি। ‘বসন্ত বাহার’, ‘প্রফেসর’, ‘জাংলি’, ‘সুরাজ’, ‘এন ইভিনিং ইন প্যারিস’, ‘লাভ ইন টোকিও’, ‘দিল এক মন্দির’, ‘দিল আপনা আউর প্রীত পারায়া’, ‘জব পেয়ার কিসিসে হোতা হায়’– এর মতো সুপার ডুপার হিট ছবিতে রাফির গান দারুণ সমাদৃত হয়। ‘বাহারো ফুল বারসাও’, ‘আব হ্যায় দাসতান তেরি ইয়ে জিন্দেগি’, ‘চাহে কোই মুঝে জাংলি কাহে’ ইত্যাদি গান দর্শকদের মুখে মুখে ফেরে। শংকর-জয়কিষণের সুরে ৩৪১টি গান করেন তিনি।

সংগীত পরিচালক রাভির সুরে ‘নীল কমল’ ছবিতে গান গেয়ে ১৯৬৮ সালে সেরা গায়ক হিসেবে ভারতের জাতীয় পুরস্কার পান রফি। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন এ ছবির ‘বাবুল কি দোয়া লেতি যা’ গানটি গাওয়ার সময় তিনি এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন যে কান্না সামলাতে পারেননি। রাভির সুরে তিনি ‘চায়না টাউন’, ‘কাজল’, ‘দো বদন’ ছবিতে গান করেন।

রফি সবচেয়ে বেশি গান করেছেন লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল জুটির সংগীত পরিচালনায়। ৩৬৯টি গান করেন তিনি এই জুটির সুরে। এই জুটির সুরে ‘দোস্তি’ ছবিতে ‘চাহুঙ্গা ম্যায় তুঝে সাঁঝ সভেরে’ গানটি গেয়ে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান তিনি।

সত্তরের দশকে ‘পাগলা কাহিকা’, ‘হির রানঝা’, ‘সাওন ভাদো’, ‘জীবন মৃত্যু’, ‘দ্য ট্রেইন’, ‘সাচ্চা ঝুটা’, ‘পাকিজা’, ‘মেহবুব কি মেহেন্দি’, ‘গ্যাম্বলার’, ‘অভিমান’, ‘ইয়াদো কি বারাত’, ‘লোফার’, ‘দাস্তান’ ইত্যাদি হিট ছবিতে গান করেন তিনি।

সত্তরের দশকেই ‘তুম মুঝে ইয়ু ভুলা না পাওগে’, ‘ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহেফিল’, ‘গুলাবি আঁখে’, ‘আজ মৌসাম বারা বেইমান হ্যায়’, ‘কান মে ঝুমকা’, ‘তেরে বিন্দিয়া রে’ ইত্যাদি গানে তিনি শ্রোতাদের মনে ঝড় তোলেন।

বাংলায় বেশ কিছু জনপ্রিয় গান রয়েছে মোহাম্মদ রাফির কণ্ঠে। ‘ওরে মনকে এমন দাগা দিয়ে’, ‘ওই দূর দিগন্ত পারে’, ‘নাই বা পরিলে আজ মালা চন্দন’, ‘কথা ছিল দেখা হলে’, ‘এ জীবনে যদি আর কোনোদিন’, ‘নওল কিশোর’, ‘কালো কলেবর কানহাই’, ইত্যাদি গান এখনও শ্রোতাদের মন ভরায়। তার অনিন্দ্য কণ্ঠে নজরুল সংগীত ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন’ গায়কীতে আজও অনন্য।

মান্না দে, কিশোর কুমার, মুকেশ, হেমন্তকুমার, গীতা দত্ত, সুমন কল্যাণপুর, লতা মঙ্গেশকার, আশা ভোঁসলেসহ সমসাময়িক প্রায় সব শিল্পীর সঙ্গেই গান করেছেন মোহাম্মাদ রফি। শাস্ত্রীয়, লোকজ, পপসহ সব ধরনের গানেই তার পারদশির্তা ছিল অসাধারণ। কণ্ঠে মাধুর্য যেমন ছিল তেমনি ছিল চটক। কাওয়ালি, ভজন, গজল, আধুনিক কোনো গানেই তার প্রতিভার কমতি ছিল না।

তিনি ছয়বার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মাননায় ভূষিত করেছে।

১৯৮০ সালের ৩১ জুলাই মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় এই জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীর।

মোহাম্মাদ রফি ১৯২৪ সালের আজকের দিনে (২৪ ডিসেম্বর) অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবে জন্মগ্রহণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.