জন্মদিনে স্মরণঃ শচীনদেব বর্মণ
বাবলু ভট্টাচার্য : ‘সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল’– এ শুধু তাঁর গানের পঙক্তি নয়, আশ্চর্য বৈভব মণ্ডিত তাঁর সঙ্গীত জীবনের চলার ছন্দ। তিনি বাংলা সঙ্গীতের রাজপুত্র– শচীন দেব বর্মণ। তিরিশ থেকে ষাটের দশক ছিল বাংলা গানের ‘সোনার দিন’৷ প্রাণভরে আধুনিক বাংলা গান শোনার দিনও। আর বাংলা গানের সেই সোনার দিনের নির্মাণ যাঁদের হাতে হয়েছিল তাঁদের এক অগ্র জন ছিলেন শচীনদেব বর্মণ।আধুনিক বাংলা গানের গায়কীর অনেকটাই তৈরি করে দিয়েছিলেন শচীনদেব বর্মণ। হওয়ার কথা ত্রিপুরার রাজা, হয়ে গেলেন আধুনিক বাংলা গানের মুকুটহীন রাজা । ‘সব ভুলে যাই তাও ভুলিনা বাংলা মায়ের কোল’ আজও যে গান তার সুরের মায়ায় আমাদের দুলিয়ে দেয় । পিতা নবদ্বীপচন্দ্র দেব বর্মন, মা মণিপুরের রাজকুমারী নির্মলা দেবী৷ বাল্য ও কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে কুমিল্লাতেই৷ দু’বছর বয়সে মাতৃহারা হন৷ কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন৷ কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হলেও গানের জন্য শিক্ষা অসমাপ্ত থেকে যায়। পিতা চেয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার পর পুত্র আগরতলায় ফিরে এসে রাজকার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন৷ কিন্তু শচীন আবদ্ধ হলেন সুরের মায়ায়। চেতনায় তখন ত্রিপুরার বাঁশের বাঁশি, ভাটিয়ালির সুর, মাঝি-মাল্লাদের জীবন ও জীবিকার সুর, গোমতী নদীর অপরূপ ছন্দ, কুমিল্লার গাছ-গাছালি, নদী- নালা আর মাঝি-মাল্লাদের মাটির গন্ধমাখা সুর।

শচীন দেবের সঙ্গে কুমিল্লার সম্পর্ক না বললে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলা সম্পূর্ণ হয় না। ত্রিপুরা তাঁকে দিয়েছিল পারিবারিক আভিজাত্য, কুমিল্লা দিয়েছিল সুর আর বাকি জীবনের চলার ছন্দ। আর কলকাতা দিয়েছিল শচীন দেবের প্রতিষ্ঠা আর মুম্বাই দিয়েছিল যশ ও খ্যাতির আকাশ। রাজ পরিবারের আভিজাত্য গায়ে মেখেও শচীন দেব মাটির প্রতি মমত্ব বোধ আর মাটির গন্ধমাখা সুর আহরণ করে আধুনিক বাংলা গানের পথচলার কায়দাটাই যেন নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। পল্লী বাংলার মেঠো সুরকে আশ্রয় করে তিনি মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিলেন। মৃত্যুর চার দশক পরেও তাঁর গান সমান লোকপ্রিয়। কলকাতা বেতার কেন্দ্রে প্রথম গান গাইলেন ১৯২৫ সালে৷ তখন সবে কলকাতা বেতারের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। শচীন দেবের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে। তাঁর কিছুটা অনুনাসিক কণ্ঠস্বরের জন্য প্রথমে তখনকার মুখ্য রেকর্ড কোম্পানি এইচএমভি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। হিন্দুস্থান থেকে প্রথম রেকর্ড প্রকাশের পর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সন্তান হওয়ায় পারিবারিক আভিজাত্য শচীন দেবের শিল্পী হয়ে ওঠা বা প্রতিষ্ঠায় অনুঘটকের কাজ করেনি বিন্দুমাত্র, বরং কিছুটা অভিমানই ছিল রাজ পরিবারের প্রতি। ১৯৪৪ সালে স্থায়ীভাবে মুম্বাই চলে যাবার পর ত্রিপুরার প্রতি ভালোবাসার টান থাকলেও রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হতে থাকে। ১৯৪৬ সালের পর শচীন দেব আর আগরতলায় যাননি। কোন রাজপরিবারের আভিজাত্যের ছাপ না থাকা মীরা দাশগুপ্তাকে বিবাহ আগরতলায় তাঁর পরিজনরা মেনে নেয় নি। তাঁর অভিমান ও রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার কারণ হয়তো এটাই। পরিতাপ ও লজ্জার কথা, সহধর্মিণী শিল্পী মীরা দেব বর্মণ– যার ত্রিপুরার রাজবধূ হওয়ার কথা ছিল; তাঁর শেষ জীবনের আশ্রয় হয়েছিল মুম্বাই শহরতলীর বারো ফুট বাই দশ ফুট ঘরের এক বৃদ্ধাশ্রমে। মুম্বাই ফিল্ম জগতে শচীন দেবের অবদান আর নিজেরও প্রতিষ্ঠার মূলে যে মানুষটার অবদান সবচেয়ে বেশি তাও ভুলে গিয়েছিলেন শচীন দেবেরই পুত্রবধূ আশা ভোসলে।

রাহুল দেব চলে গেছেন, মুম্বাই ফিল্ম জগতও চমকে ওঠেনি। শচীন দেবের পুত্রবধূ আশা ভোশলে চুপি চুপি নবতিপর মীরাকে রেখে এসেছিলেন এক বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমের কর্তৃপক্ষও জানতেন না কে এই বৃদ্ধা, যখন মীরাকে সম্মানিত করার কথা জানিয়ে ত্রিপুরা সরকারের চিঠি তাদের ঠিকানায় পৌঁছেছিল। এক আশ্চর্য সাংগীতিক আভিজাত্যের মোড়ক শচীন দেবকে মর্যাদা মণ্ডিত করেছিল। কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কাছে গান শিখেছিলেন৷ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। হিন্দি সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনায় গগনচুম্বী খ্যাতি পেয়েছিলেন৷ কিন্তু নিজেকে এক মর্যাদা মণ্ডিত ‘ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালি’ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে দেননি কাউকে৷ কলকাতার শহুরে বাংলা ভাষাও রপ্ত করার কোন চেষ্টা করেন নি৷ ভোলেননি কুমিল্লার ভাষাভঙ্গি। আবার এপার বাংলার প্রতি অনেক অভিমানও ছিল শচীন দেবের। আধুনিক বাংলা গানের গায়ন শৈলীতেই এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। শুধুমাত্র ঈষৎ অনুনাসিক ও দরাজ কণ্ঠস্বরের জন্যই নয়, বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর নিবিড় আত্মীয়তার ফলে বাংলার লোক সুর আর মাঝি- মাল্লাদের সঙ্গে মিশে তাদের সুর তুলে এনেছিলেন আর আশ্চর্য দক্ষতায় শাস্ত্রীয় সুরের সঙ্গে মাটির সুরের মিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলা গানকে দান করেছিলেন অপার ঐশ্বর্য। কলকাতায় অবস্থানকালে শচীন দেব গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি গণনাট্য সঙ্ঘের বাংলা লোকসঙ্গীত শাখার সভাপতি ছিলেন। শচীনদেব লিখে গেছেন “… আই পি টি এর সঙ্গে জড়িত থাকাকালে বুঝতে পারলাম ভারতবর্ষের লোকসঙ্গীত কত বিচিত্র ও বৃহৎ সংগীত সম্পদে পুষ্ট”৷ আমাদের অপার বিস্ময় বাংলা ছায়াছবি শচীনদেবের সুরের ঐশ্বর্য প্রায় বর্জনই করেছিল। ১৯৩২ সালে বাংলা ছায়াছবি সবাক হওয়ার পর ১৯৩৮ সালের মধ্যে মাত্র ৫/৬টি বাণিজ্যিক ভাবে অসফল বাংলা ছায়াছবিতে তিনি গান গেয়েছিলেন। একথাও মনে করা যেতে পারে যে শচীন দেবের সাংগীতিক রুচি ও আভিজাত্য সেকালের ছায়াছবির জগতের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি। তিনি অন্যের সুরে গান করতেন না। সঙ্গীত পরিচালক অন্য কেউ হলেও তাঁর গীত গানের সুর তিনি নিজেই করতেন। শুধুমাত্র একটি ছায়াছবিতে নজরুল ইসলামের সুরে একটি গান করতে সম্মত হয়েছিলেন। আর একটি শর্ত থাকত তাঁর, তাঁর গাওয়া গান ছবির কোন চরিত্রের কণ্ঠে থাকবে না, শুধুমাত্র নেপথ্য দৃশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে গীত হবে। কিন্তু ক্ষতি যে বাংলা চলচ্চিত্রের হয়েছিল তাতে সংশয় নেই। বাংলা ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসাবেও শচীনদেব কোন সুযোগ পাননি। ১৯৩২ সালে বাংলা ছায়াছবি সবাক হওয়ার পর দুটি অসফল ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন৷ তারপর কোন প্রযোজক, পরিচালক তাঁকে ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ দেন নি। কোন ডাক না পেয়ে কিছুটা অভিমান নিয়েই বাংলা ছেড়ে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে মুম্বাই যাওয়ার প্রথম ডাক পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন বাংলাতেই থাকার। কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র জগত থেকে কোন ডাক না পেয়ে অভিমানাহত হয়ে ১৯৪৪ সালে মুম্বাই চলে গেলেন পাকাপাকি ভাবে। তারপর হিন্দি সিনেমার গান তাঁর সুরের জাদুতে কি অসামান্য উচ্চতা স্পর্শ করেছিল তা তো ইতিহাস হয়ে আছে।

মুম্বাই সিনেমার গান ঐশ্বর্যময়ী হয়ে উঠলো বাংলার মাটির সুরের স্পর্শে আর বাংলা ছায়াছবি শচীনদেবের ছোঁয়া পেল না। কিন্তু যেটুকু পেয়েছে বাংলা সঙ্গীত জগত তাই বা কম কি?
শচীনদেব বর্মণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন– পদ্মশ্রী, সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার, এশিয়া ফিল্ম সোসাইটি পুরস্কার, সন্ত হরিদাস পুরস্কার৷ পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার পুরস্কার৷
২০০৭ সালে ভারতীয় ডাক বিভাগ তাঁর সম্মানে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে ৷
শচীনদেব বর্মণ ১৯০৬ সালের আজকের দিনে (১ অক্টোবর) বাংলাদেশের কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment