জন্মদিনে স্মরণঃ স্মি তা পা তি ল
বাবলু ভট্টাচার্য : মেয়েদের রূপের আসল কেমিষ্ট্রি যে বুদ্ধির তীক্ষ্ণতায় আর মেধার ঔজ্জ্বল্যে, সেটা তাকে দেখেই আমার প্রথম বোধোদয় ঘটেছিল। আসলেই তো, চেহারায় বুদ্ধির ছটা না থাকলে সে আবার সুন্দরী হয় কি ভাবে?
তিনি ছিলেন আমার প্রথম প্রেম— আমার কৈশোরের প্রথম মুগ্ধতা।
অসম্ভব ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত আর আত্মপ্রত্যয়ী এক জোড়া চোখ স্মিতার আসল সৌন্দর্য্য। তথাকথিত গ্লামারবিহীন আপাত অগোছালো অতীব সাদামাটা চেহারা— অথচ এর বিপরীতে, তার মেদবিহীন দীর্ঘ ছিপছিপে তনু, নির্মল নিস্কলুষ সারল্যের হাসি, মেধার ঔজ্জ্বল্যে ঝলমলে তার স্বাধীনচেতা নারীর ইমেজ— স্মিতা পাতিলকে করে তুলেছিল ৮০র দশকের যৌবনদৃপ্ত নতুন আইকন।
ফলে পুরুষের প্রতি তার লাস্য, তার মোহময়তা তার শরীরী বিভঙ্গ— সব কিছুই এক অন্য মাত্রার, ভিন্ন প্রকৃতির…।
স্মিতা পাতিলের ক্যারিয়ারের শুরু দুরদর্শনে (সরকারী টেলিভশন) খবর পড়ার মধ্য দিয়ে। দুরদর্শনের এই অডিশন এবং কাজের শুরুটাও বেশ নাটকীয় ভাবে। দুরদর্শনে চাকরি করতো স্মিতার বোন অনিতার বান্ধবী জ্যোৎস্না ক্রিপকার।
কৌতুহলী স্মিতা টেলিভিশন স্টুডিওর অন্দরমহলটা কেমন তা দেখার জন্য তার বোন এবং তার বান্ধবীর সাথে হাজির হয় মুম্বাই দুরদর্শন কেন্দ্রে। ঘটনা চক্রে সেদিন ছিল দুরদর্শনে সংবাদ পাঠক/পাঠিকাদের অডিশন। অনিতার বান্ধবী জ্যোৎস্নার আগ্রহে স্মিতা অডিশনে অংশ নেয় এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে সংবাদ পাঠিকা হিসাবে নির্বাচিত হয়।
কিন্ত সমস্যা দেখা দেয় নিয়োগপত্র দেওয়ার সময়, স্মিতা তখনও কলেজের ছাত্রী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক বিধায় তার সাথে দুরদর্শন কোন চুক্তিপত্র স্বাক্ষর না করে তাকে দৈনিক ভাতার শর্তে চাকরীতে নিয়োগ দেয়। শুরু হয় সংবাদ পাঠে স্মিতার প্রথম ক্যারিয়ার। পরিচিত হয়ে উঠে দুরদর্শনের নতুন মুখ হিসাবে। ফিল্মসিটি মুম্বাইয়ের অনেকেরই নজর পড়ে তার উপর…
চিত্রপরিচালক শ্যাম বেনেগাল তাদের মধ্যে একজন। তার নতুন ছবি ‘চরণদাস চোর’- এর জন্য তিনি পছন্দ করেন স্মিতাকে।
‘চরণদাস চোর’ দেখে স্মিতা পাতিলের মা-বাবা রীতিমত মুগ্ধ। ছবিতে রাণীর ভূমিকায় স্মিতাকে এত মিষ্টি আর আকর্ষনীয় লাগছিল যে, বেনেগাল যখন স্মিতাকে নিয়ে আর একটা ছবি বানানোর প্রস্তাব দিলেন বিদ্যা পাতিল— স্মিতার মা আর না বলতে পারলেন না। শুরু হলো স্মিতার নতুন ছবি ‘নিশান্ত’।
‘ভূমিকা’ ছিল স্মিতাকে নিয়ে শ্যাম বেনেগালের তৃতীয় ছবি, যে ছবি স্মিতাকে সর্বভারতীয় পরিচিতি এনে দেয়। প্রথমবারের মতো স্মিতা সেরা অভিনেত্রীর রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভুষিত হন।
এরপর থেকেই বলিউডের মুলধারার ছবি তথা কমার্শিয়াল ছবিতে অভিনয়ের অফার আসতে শুরু হয়, কিন্ত স্মিতার দৃঢ় সিদ্ধান্ত— যে সব ছবিতে নারীকে বিকৃত করে উপস্থাপন করে এবং যা নারীর জীবন সংগ্রামকে মর্যাদা দেয় না— এমন ছবিতে তিনি অভিনয় করতে পারেন না।
কিন্ত স্মিতা তার এই ধারনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। শুরুতে স্মিতার বেশ বেগ পেতে হয়েছে বলিউডের কমার্শিয়াল ছবির চটুল সংলাপ আর উত্তেজক পোষাকের সাথে খাপ খাওয়াতে। সুড়সুড়ি দেওয়া নাচের পোজ তো ছিলই। তবে তার তুমুল পেশাদারীত্ব খুব দ্রুত তাকে সাহায্য করেছে এ সবের সাথে মানিয়ে নিতে। শুটিং শুরু হয় অমিতাভ বচ্চনের সাথে ‘নমক হালাল’ ছবির। পরিচালক প্রকাশ মেহরা, সালটা ১৯৮২।
তার অভিনীত ছবির সংখ্যা ৮০। এসবের মধ্যে ‘চরণদাস চোর’, ‘আর্থ’, ‘চক্র’, ‘মন্থন’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘ভূমিকা’, ‘মির্চ মসালা’, ‘মাণ্ডি’, ‘দেবশিশু’, ‘উমবার্তা’, ‘আক্রোশ’, ‘অর্ধসত্য’ ও ‘সদগতি’ (সত্যজিৎ রায় পরিচালিত) অন্যতম।
অভিনয়ে অনন্য অবদানের জন্য তিনি দুটি জাতীয় পুরস্কার, একটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জেতেন। এছাড়াও তার অর্জনের ঝুলিতে ছিল ১৯৮৫ সালে পাওয়া ভারতের চতুর্থ শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘পদ্মশ্রী পুরস্কার’ও।
রাজ বাব্বর আর স্মিতা পাতিলের একমাত্র সন্তান ‘প্রতিক বাব্বর’। যাকে জন্ম দিতে প্রসব সংক্রান্ত জটিলতায় এবং মস্তিস্কের রক্ত ক্ষরণে স্মিতা পাতিল মারা যান মুম্বাই এর যশলোক হাসপাতালে ১৯৮৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর।
স্মিতা পাতিল ১৯৫৫ সালের আজকের দিনে (১৭ অক্টোবর) পুণে-তে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment