Press "Enter" to skip to content

স্বস্তিকা শব্দটির অর্থ মঙ্গল বা কল্যাণ….।

Spread the love

ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ২০ এপ্রিল ২০২৫।
“স্বস্তিকা” শব্দটির অর্থ মঙ্গল বা কল্যাণ ৷”সু” এবং “অস্তি” দুটি ব্রাহ্মী হরফের যোগফল ৷ সু অস্তি বা শুভ অস্তিত্ব ৷ যা সব বাধা বিপত্তি দূর করে ৷ এজন্য হিন্দু , জৈন , বৌদ্ধ ধর্ম সহ পৃথিবীর নানা দেশে বহু প্রাচীনকাল থেকে এর ব্যবহার করা হয়েছে ৷ গবেষকদের মতে এর ব্যবহার এগারো হাজার বছরেরও আগে থেকে ! অনেকে একে সৌভাগ্য , সৃষ্টি ও জীবনের প্রতীক সূর্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ভেবেছেন ৷ হিন্দুর চার বেদেও স্বস্তিকা বা স্বস্তিক চিহ্নের উল্লেখ আছে ৷একে ইংরেজিতে বলে “হাকেনক্রইজ” – ইউরোপে ভালোবাসার প্রতীক বললেও অনেকটা ভিন্ন ৷ আমরা হিন্দুরা বিশ্বাস করি সূর্যদেব আমাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনেন ৷এর চার বাহু সূর্যালোকিত পূর্ব , পশ্চিম , উত্তর , দক্ষিণ চারদিককে মনে করায় ৷এই চিহ্নের চারটি বাহু ব্রহ্মাকেও বোঝায় ৷ স্বস্তিকার চারদিক শৈশব , কৈশোর , যৌবন ও বার্ধক্য জীবনের চার ধাপ এবং সত্য , ত্রেতা , দ্বাপর , কলি চার যুগ বোঝায় ৷বাড়ীর সামনে স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকার কারণ যাতে মা লক্ষ্মী ঘরে অবস্থান করেন ৷
আমাদের সনাতনী সমাজে পুজোয় ঘটের উপর সহ প্রায় সব শুভ অনুষ্ঠানে এই পবিত্র চিহ্ন আঁকা হয় ৷ ভাবা হয় এতে শুভ কাজ বা পুজো নির্বিঘ্নে শেষ হবে ৷ স্বস্তিক চিহ্ন যেন স্পষ্ট ও সুন্দর হয় ৷ যা নেতিবাচক প্রভাব নষ্ট করে জীবন তথা পরিবারকে ইতিবাচক দিকে নিয়ে যায় ৷ বস্তু ও ব্যক্তির সুরক্ষা দেয় ৷ উল্টো স্বস্তিক আঁকা খারাপ ৷ কুমকুম দিয়ে রোজকার পুজোয় স্বস্তিক আঁকা যায় ৷ ঘরের দেওয়ালে হলুদ রঙ বৃহস্পতির কারক তা দিয়ে স্বস্তিক আঁকলে দাম্পত্যজীবন সুখের হয় বলে ভারতীয় জ্যোতিষ ও বাস্তুবিদরা মনে করেন ৷ ধনাত্মক অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার অভিমুখে আঁকা স্বস্তিকা বিষ্ণুর ও সূর্যদেবকেও প্রকাশ করে ৷ স্বস্তিকা গণেশেরও প্রতীক৷ঋণাত্মক স্বস্তিকা কালী , রাত্রি , তন্ত্র ও অলৌকিকতার প্রতীক ৷ বাঙালী হিন্দুর বিয়ে , নান্দীমুখের “বসুধারা” আসলে ধনাত্মক স্বস্তিকা ৷ যা পূর্বপুরুষদের সঙ্গে জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক স্মরণ করার সঙ্গে আগামী প্রজন্মের বংশবৃদ্ধির কামনা ৷ যাত্রা শুরুর আগে এই স্বস্তিকা চিহ্ন দেখে বের হওয়া শুভ ৷ সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জদাড়োতে পাওয়া সিলমোহরে স্বস্তিকা ছিল ৷প্রাক মৌর্য যুগের পাঞ্মার্কড মুদ্রায় স্বস্তিকা আঁকা থাকত ৷ তক্ষশীলার সোনার তৈরী সিলমোহরে খরোষ্ঠি লিপিতে , প্রথম শতকের রানি গুম্ফায় স্বস্তিকার ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে ৷অশোকের মুদ্রায় , শ্রীলঙ্কার প্রাচীন মুদ্রায় স্বস্তিকা ছিল ৷ ম্যাক্সমূলার তাই “স্বস্তিকা চিহ্ন” ভারতীয় উৎস জাত বলেছেন ৷
তবে , স্বস্তিক চিহ্ন অন্য দেশেও সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত ছিল ৷ ইউক্রেনের কিয়েভের জাতীয় জাদুঘরে হাতির দাঁতে তৈরী একটি পাখির মূর্তি আছে ৷ যা পনেরো হাজার বছর আগের বলে রেডিও কার্বন পরীক্ষার পর প্রত্নতাত্ত্বিকদের অভিমত ৷ গ্রিসে পিথাগোরাস স্বস্তিকাকে আকাশ ও মাটির প্রতীক বলেছিলেন ৷ সেখানকার পাত্রে , বাসনে এই প্রতীক দেখা যেত ৷ ট্রয় যুদ্ধের খননকার্যেও এর প্রমাণ পাওয়া যায় ৷ মেসোমটেমিয়া , রোম , বাইজেন্টাইন , নর্স ,উত্তর আমেরিকা ও ইথিওপিয়ার প্রাচীন ধর্মে ও সভ্যতায় এর ব্যবহার দেখা যায় ৷ কয়েকরকম খ্রিস্টীয় গির্জা এবং আজেরবাইজানের কিছু শিয়া মসজিদেও স্বস্তিকা চিহ্ন দেখা যায় ৷ ১৯৪২ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পত্রের অফিসিয়াল মনোগ্রামে স্বস্তিকা চিহ্নও ছিল ৷জার্মান নাৎসি নেতা হিটলারের পতাকায় স্বস্তিকার ( যদিও তা আমাদের উল্টো ঘড়ির কাঁটার বিপরীত মুখী) ব্যবহার বিশ্বের ক্ষতি করেছে ৷ ইউরোপবাসীরা এখন বলছেন হিটলার ভালোবাসার প্রতীক”স্বস্তিকার ” অপব্যবহার করেছে ৷ হিন্দুরা আর্য ৷ হিটলার নিজেকে আর্য ভাবলেও হিন্দুত্ব ও আর্যত্বর মূল দৃষ্টিভঙ্গী জানত না ৷ তিনি “হুকড ক্রশ” কে একটু পাল্টে স্বস্তিকা বলা শুরু করেন ৷
Longman English Dictionary তে লেখা আছে
” A sign consisting of a cross with each end bentat 90 degree , used as a sign for the Nazi party in Germany . গুগুলে হিটলারের প্রিয় স্বস্তিকা Haken Kreuz লিখলে স্বস্তিকা না লিখে hookcross দেখায় ৷ কট্টর খ্রিস্টান হিটলার আর্য ছিল না ৷ তার ছিল আর্য তথা হিন্দুত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ৷ হিটলারের স্বস্তিকা হলো হেকেনক্রুজার ৷ হেকেনক্রুজ অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের প্রতীক ৷ আর্যত্ব ও হিন্দুত্বে বেমানান ৷পিটার ম্যাডসন নামের ট্যাটু শিল্পীর নেতৃত্বে সেখানে একটি আন্দোলন শুরু হয়েছে ৷ তাঁরা বলছেন
এর পুনঃব্যবহার হোক আর তা অসম্ভব নয় ৷ আমরা হিন্দুরা কিন্তু প্রাচীন কাল থেকে এই বামমুখী স্বস্তিকাকে অশুভ ভেবেছি৷
জৈন ধর্মে স্বস্তিকা চিহ্নটি পার্শ্বনাথ বা পরেশনাথকে বোঝানো হয় ৷ তাঁদের আটটি মঙ্গল চিহ্নের অন্যতম ৷ স্বস্তিকার সঙ্গে তিনটি বিন্দুকে শুদ্ধ বিশ্বাস , সৎ জ্ঞান ও সৎ আচরণ বোঝানো হয় ৷ বৌদ্ধরা বুদ্ধের বুকে , হাতে , পায়ে স্বস্তিকাকে বুদ্ধদেবের হৃদয় মনে করেন ৷ যা সৌভাগ্য ও নির্বাণকে বোঝায় ৷লাল স্বস্তিকা বুদ্ধের পবিত্র গুণাবলি ,নীল স্বস্তিকা মহাজাগতিক গুণ , হলুদ স্বস্তিকা অনন্ত সমৃদ্ধি , সবুজ স্বস্তিকা চাষের স্বচ্ছলতা বোঝায় ৷ দলাই লামার সিংহাসনে চারটি স্বস্তিকা আঁকা আছে৷আমরা হিন্দুরা স্বস্তিকার চার বিন্দু বলতে ব্রহ্মান্ডকে বোঝাই ৷ যা পরম শিব ও শক্তির মিলনে উদ্ভুত ৷ এরকম বিভিন্ন বিষয়ে আরো সুবিস্তারে জানতে পড়ুন ও পড়ান আমার লেখা “সনাতনী কৃষ্টিকথা ” ও ” হিন্দু ধর্ম ” বইদুটি ৷

More from CultureMore posts in Culture »
More from InternationalMore posts in International »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *