স্মরণঃ কা জী ন জ রু ল ই স লা ম
“গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে নাহি কিছু বড়
নাহি কিছু মহীয়ান।”
[ কাজী নজরুল ইসলাম ]
বাবলু ভট্টাচার্য : অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধুমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ, বিষের বাঁশিতে পরিসমাপ্তি। বাঙালি মননে তাঁর মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি যতটা না বিদ্রোহী, তার চেযে অনেক বেশি প্রেমিক। বাঙালি মণীষার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন কাজী নজরুল ইসলাম।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নেয়া নজরুল ছিলেন ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের পুত্র। নাম রাখা হল দুখু মিঞা। মাত্র আট বছর বয়সেই বাবাকে হারান তিনি। স্কুলে পড়াকালীনই তিনি গল্প ও কবিতা লিখতে শুরু করেন।
স্কুলের পড়া শেষ না করেই কাজী নজরুল ইসলাম ৪৯ নম্বর বাঙালি রেজিমেন্টে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে মেসোপটেমিয়ায় চলে যান (১৯১৭)। সেখানে বাঙালি পল্টনের মুসলমান সেনাদের তদারকির কাজে একজন পাঞ্জাবি মৌলবী যুক্ত ছিলেন। তাঁর মুখে হাফিজের কবিতা শুনেই মুগ্ধ নজরুল মৌলবী সাহেবের কাছে ফার্শি শিখতে থাকেন।
কবি দেশে ফিরলেন দু’বছর পরে অর্থাৎ ১৯১৯ সালে। ক্রমে সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, প্রবাসী ইত্যাদিতে কবিতা লিখে কলকাতার সাহিত্যমহলে তিনি সুপরিচিত হলেন। ১৯২২ সালে ‘বিজলী’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে তিনি আলোড়ন ফেলে দিলেন।
মুজফ্ফর আহমেদের সঙ্গে যৌথ ভাবে সম্পাদনা করলেন ‘নবযুগ’ পত্রিকা। তারপরে প্রকাশ করলেন ‘ধূমকেতু’ (১৯২২) পত্রিকা। এখানেই তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশ হলে প্রবল প্রতিবাদী সত্তার অজুহাতে তাঁকে কারারুদ্ধ করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার।
রবীন্দ্রদর্শন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইলেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কিন্তু নজরুলকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। আবার রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অন্তরের আকর্ষণ অনুভব করা যায় তাঁর ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের নামকরণটি দেখে। কারণ রবিঠাকুরের একটি গানই এর প্রেরণা— ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে’।
প্রাণের আবেগে ভরা তরুণ কবি নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ (১৯২৩) নাটকটি উৎসর্গ করেছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনও বড় যন্ত্রণাময় ছিল কবির। ১৯২৪ সালে তাঁর বিয়ে হয় প্রমীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে। সস্ত্রীক হুগলিতেই বাস করতে থাকলেন। তখন থেকেই সক্রিয় ভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েন। গঠিত হয় স্বরাজ-পার্টি তথা তাঁদের মুখপত্র ‘লাঙল’ পত্রিকা।
ইতিমধ্যে দুই পুত্রসন্তানের অকালমৃত্যু কবিকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে। অধ্যাত্ম-আশ্রয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হন। আবার ১৯৪০ সালে স্ত্রী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। ১৯৪২ সালে কবি নিজেও দুরারোগ্য পক্সরোগে আক্রান্ত হন। যাতে ক্রমশ তাঁর মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা চলে যায়, তিনি সৃষ্টির দুনিয়া থেকে নির্বাসিত হন।
কাজেই আমরা বুঝতেই পারছি ৭৭ বছরের জীবন হলেও সৃষ্টির জন্য তিনি পেয়েছেন মাত্র ২২-২৩ বছর। কিন্তু এরই মধ্যে তাঁর সৃষ্টি সম্ভারের প্রাচুর্য দেখলে অবাক হতে হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল- ‘অগ্নিবীণা’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গান’, ‘ফণিমনসা’, ‘পূবের হাওয়া’, ‘চিত্তনামা’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সন্ধ্যা’, ‘সর্বহারা’, ‘ঝিঙেফুল’ ইত্যাদি।
তিনি হাফিজের অনুবাদও করেছিলেন- ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ নামে। ‘রিক্তের বেদন’, ‘শিউলিমালা’ ইত্যাদি তাঁর গল্পগ্রন্থ। ‘বাঁধন-হারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’, ‘কুহেলিকা’ তাঁর উপন্যাস। এ ছাড়া ‘ঝিলিমিলি’ ও ‘আলেয়া’ নামে দু’টি নাটকও রয়েছে। ‘দুর্দিনের যাত্রী’ ও ‘রুদ্রমঙ্গল’ নামে দু’টি প্রবন্ধের বইও আছে তাঁর।
গান বাদ দিয়ে নজরুলের স্মৃতিতর্পণ সম্পূর্ণ হতে পারে না। সমসময়ে তাঁর গানগুলি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়ে থাকে। এটা একটা বিস্ময় যে, এত কম সময়ে তিনি প্রায় চার হাজার গান রচনা করেন। গ্রামাফোন রেকর্ড কোম্পানির চাহিদাতেই তাঁর এই বিপুল সংখ্যক গান রচনা।
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালের আজকের দিনে (২৭ আগস্ট/ ১২ই ভাদ্র) ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment