লেখা – সাতক্ষী কুন্ডু
গত কালের ‘দাদাগিরি’ অনেকেই হয়তো দেখেছেন,আবার অনেকেই দেখেননি। শো-টা দেখতে দেখতেই ভাবছিলাম কিছু লিখবো। জানি লিখে কিছুই হয়না,তবুও লিখবো।
আজ ছয়জন বিদেশি মানুষ এসেছিলেন শো-তে। ‘বিদেশি’ শব্দটা খুব বাহ্যিকভাবে বললাম কারণ এদের কাউকেই বিদেশি বলা যায়না। এরা ভারতীয় এবং মনেপ্রাণে বাঙালি। এরা কেউ এসেছেন ইংল্যান্ড,ফ্রান্স থেকে, কেউ আবার ব্রাজিল কিংবা বেলজিয়ামের মাটিতে জন্মেছেন। দীর্ঘদিন এদেশে এসে তারা থাকছেন,কাজ করছেন। কেউ ডাক্তার,কেউ গবেষণা করছেন বাংলার ইতিহাস নিয়ে,কেউ পড়াশোনা করছেন ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র,কেউ বাংলার আদিবাসী গ্রামে ঘুরে ঘুরে তাদের নাটক শেখাচ্ছেন,কেউ ফুটবলের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন,আবার কেউ ইউনেস্কোর কাজ করার সূত্রে বাংলায় এসে হয়ে উঠেছেন এখানকার গৃহলক্ষ্মী।
আমরা বাংলা বলতে লজ্জা পাই। বাংলা মিডিয়ামে সন্তানদের পড়াতে দিতে নাক সিঁটকে ওঠে বাঙালি বাপ-মার। কথায় কথায় কিছু ইংরেজি বাক্য নিদেনপক্ষে ‘you know’, ‘oh its like’, ‘so’, ‘because’, ‘yup’ এসব ব্যবহার করলে তবেই জাতে উঠছি বলে মনে করি। আমাদের আজকের বাঙালি ‘সেলেব’ তো বাংলা বলতেই জানেন না নির্ধারিত সংলাপটুকু ছাড়া। মোট কথা,মাতৃভাষাটা নিয়ে আমাদের লজ্জার শেষ নেই। কিন্তু আজকে দেখলাম এই ছয়জন বিদেশিকে যারা অবলীলায় বাংলা বলে চলেছেন,যতটা সম্ভব কম ইংরেজি শব্দ আসছে তাদের বাচনে। এত শ্রুতিমধুর শোনাচ্ছে বাংলা ভাষা তাদের মুখে যে কি বলবো! আমরা বাংলায় কথা বলতে লজ্জা পাই,তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন লজ্জাটা আসলে কোথায়।
ডঃ ক্রিস্টোফারের কথায় আসি। তিনি গোটা পরিবারকে ছেড়ে এখানে আছেন। ‘বাংলার কি ভালো লাগে?’, উত্তরে বললেন ‘সব’। বিদেশের তুলনায় কলকাতায় সবুজ একটু কম,লোক বেশি,এটুকুর বাইরে বিদেশের কোনকিছুই তিনি মিস করেন না। কলকাতা তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে। চামচ দিয়ে ভাত খাননা, হাত দিয়ে মেখেই মুখে তোলেন ভাত-ডাল-পোস্ত। শুনতে শুনতে চোখে ভেসে উঠছিল সেইসব বাঙালিদের মুখ যারা উঠতে বসতে বাংলার তথা দেশের সবকিছুতেই বিরক্তি প্রকাশ করে,ত্রুটিগুলো সংশোধনের দিকে বিন্দুমাত্র মনোযোগ না দিয়ে তারা কেবলই দেশ ছেড়ে ভিটে ছেড়ে পরিজন ছেড়ে স্থায়ী বাসিন্দা হতে চায় বিদেশের,NRI হতে পেরে গর্বের হাসি ঝরে পড়ে তাদের মুখে। মনে পড়ছিল বিদেশি কায়দা প্রাণপনে রপ্ত করতে চাওয়া বাঙালি হতভাগ্যদের যারা রেস্টুরেন্টে হাত দিয়ে খাবার খেতে গেলে স্ট্যাটাস চলে যাচ্ছে ভাবে,এমনকি বাড়িতেও চামচের ব্যবহারেই নিজেদের উন্নত লাইফস্টাইল সাজায়।
আসি ছিয়াত্তর বছরের এক বৃদ্ধের কথায় যিনি বাংলার ইতিহাস নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি তুমুল ভালোবাসেন বাংলা চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত। সত্যজিতের ছবি দেখে নামটা বলতে তার একমিনিটও ভাবতে হয়না। হা বাঙালি নব্যযুবক-যুবতী, তোমরা তো বাংলা সিনেমা দেখতেই লজ্জা পাও! বাংলা ভাষায় ক্লাসিক সৃষ্টি হতে পারে তোমরা মানতেই চাওনা, তোমরা ভুলেই যেতে বসেছো সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালকে। অথচ তোমাদেরই সামনে এক বিদেশি মানুষ উদাত্ত কন্ঠে গেয়ে ওঠেন ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’। রোদ্দুর রায় শুনে মজা পাওয়া বাঙালি, বাংলা সাহিত্যকে ভুলতে বসা বাঙালি, রক,জ্যাজ আর ফিউশনে মত্ত বাঙালি — তোমাদের পিঠের মাঝবরাবর সপাৎ করে কিছু আছড়ে পড়ে কি?
বাঙালি খাবার খেতে আমরা আজকাল অনেকেই ভুলেছি,অথচ পুরুলিয়ায় থাকা মেক্সিকান ব্রতচারিনী প্রিয় খাবার হিসেবে নাম করেন মাড়-ভাত এবং আলুচোখার। এদেশের ধর্ম-দর্শন নিয়ে এদের অনেকেরই পড়াশোনা,সেই ধর্মকে জানতে এরা উন্মুখ যাকে আমরা ভারতীয়রা প্রায় ভুলতে বসেছি নয়তো বা ধর্মের আসল সারাৎসার না জেনে কেবলই মিথ্যের মুখোশে বীতস্পৃহ হয়ে তাকে দুয়ো দিয়ে চলেছি।
প্যারিস থেকে আসা সুপুরুষ যুবাটি যখন গল্প শোনান তাঁর বিবাহের এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে পাল্কি চেপে বিবাহ পরবর্তী ছবিটিও দর্শকদের সঙ্গে শেয়ার করেন,তখন বুঝি বাংলাকে,ভারতকে এই ভালোবাসা কতটা অন্তর থেকে হয়। অথচ আমরা এখানকার ভূমিসন্তান হয়ে এর কণামাত্র প্রেমকে রক্তে লালন করিনা। আমরা এন আর আই জামাই পেলে গোটা পাড়ায় মাইক নিয়ে শোনাতে বসি সৌভাগ্যের খবরটি। হা হতস্মি!
শেষ করবো নেলিনের কথা বলে। ইউনেস্কোর কাজের সূত্রে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তার স্বামীর যিনি চন্দননগরের বাসিন্দা। তারপর থেকে প্রায় তিরিশ বছর এখানেই তিনি বিবাহিত জীবন কাটাচ্ছেন। সংসার করছেন মনের আনন্দে,রাঁধছেন ভাপা ইলিশ,শাশুড়ির সমস্ত কড়া নিয়মকে পালন করছেন হাসিমুখে। কারণ তিনি বাংলার সবকিছুকে ভালোবেসেছেন। দেশের জন্য তার মনকেমন করেনা কারণ মনকে ভালো রাখতে চাইলেই ভালো রাখা যায় এটাই তার বিশ্বাস। নেলিনের ভাবনায় আজ আরও দুটো জীবনসত্য উঠে এল যার উৎস কিন্তু ভারতীয় দর্শন অথচ এক অভারতীয় আমাদের মর্মে ঘা দিয়ে তা মনে করিয়ে দিলেন। নেলিন বললেন ‘ঠাকুরের সামনে ওসব ফল টল দিলেই তো পুজো হয়না,আসল পুজো হল মনের পুজো। মন থেকে তাই ঠাকুরকে নমস্কার করি’ আর জানালেন ‘আমার কাছে রাষ্ট্রপতি থেকে রিকশাওয়ালা সবাই সমান’। আহা,আমরা কবে বুঝবো এই মানবতাকে!
আজকের দেড়ঘন্টার ‘দাদাগিরি’ যেন আয়না হয়ে উঠেছিল একজন বাঙালির সামনে,একজন ভারতীয়ের সামনে। ওয়েস্টার্ন পোশাকে অভ্যস্ত বাঙালি তুমি দেখলে নিশ্চই পাজামা-পাঞ্জাবি-জহরকোটে পৌরুষকে কত ব্যক্তিত্বময় লাগে?তুমি অনুভব করলে নিশ্চই যে শাঁখা-পলা হাতে সিঁথির সিঁদুরে নিজেকে রাঙালে বাঙালি বধূর আর কোন মেকআপের প্রয়োজনই পড়েনা? লাল পাড় সাদা শাড়িতে আটপৌরে বাঙালি মেয়ের মাধুর্য টাইট জিন্সের তোয়াক্কাই করেনা? তুমি শিখলে তো শিক্ষার প্রকাশ ঠিক কি ধরণের ব্যবহারে? বুঝলে তো, সাদামাটা ভাবে দাঁড়িয়ে কথা বললেও নিজেকে আধুনিক রুচিসম্মত প্রমাণ করা যায়?
যাঁরা ‘দাদাগিরি’ দেখেন না,বা,আজকের এপিসোড দেখেননি তাদের বলবো অন্তত অনলাইনে দেখে নেবেন। কিছু সময় আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন হয়,দরকার হয় আত্মসমালোচনার, জরুরি হয়ে ওঠে আত্মসংশোধন। আমরা কি করছি,কিভাবে চলছি,কিভাবে নিজেদের বদলে ফেলছি,হারিয়ে ফেলছি,কিভাবে ভুলে যাচ্ছি সবকিছু, কিভাবে নিজেরাই নিজেদেরকে লজ্জিত করে চলেছি প্রতিদিন,ওই ছয়জন মানুষ তা নিজেদের আচরণ,বাচন সর্বোপরি জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন। ওনাদের প্রণাম। আর আসুন,এবার অন্তত সচেতন হই আমরা,ফিরে আসি নিজেদের কাছে নিজেরা।
লেখা সৌজন্যে — Shatakshmi Kundu
Be First to Comment