জন্মদিনে স্মরণঃ কা লী ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
“সৌমিত্র নয়, আমার আসল প্রতিদ্বন্দ্বী কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।”
—– উত্তম কুমার
বাবলু ভট্টাচার্য : যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা পেরিয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর কয়েক দশক জুড়ে বাংলার নাটক ও চলচ্চিত্রে যে স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছিল, তখন একঝাঁক শিল্পী গানে, কবিতায়, সাহিত্যে, নাটকে, চলচ্চিত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন। কালী বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য এক আশ্চর্য প্রতিভা।
তার বাবা মণীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী, রাশভারী রক্ষণশীল মানুষ। মা ভবানীদেবী। ছয় ভাই ও পাঁচ বোন নিয়ে বিরাট এক সংসারের দ্বিতীয় সন্তান কালী লন্ডন মিশনারিতে প্রাথমিক এবং সত্যভামা ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন।
স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে মস্ত খেলোয়াড় হবেন। বাবাকে লুকিয়ে খেলতে গিয়ে পুরস্কার জিতে বাড়ি ফিরেও বাবার হাতে মার খেয়েছেন অনেক বার। ফুটবল খেলায় তিনি এতটাই ভাল ছিলেন যে, বিভিন্ন ক্লাব তাকে ভাড়া করে নিয়ে যেত খেলাতে। আর প্রায় সব ম্যাচের শেষে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার তিনিই পেতেন।
কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনটাই ছিল বিচিত্র। কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলোতে বাড়ি পালিয়ে দেখেছেন সিনেমা ‘কপালকুণ্ডলা’, কিন্তু মনে ধরেনি। শিশির ভাদুড়ীর ‘চাণক্য’ ছবির শুটিং দেখতে গিয়ে ভিড়ের দৃশ্যে ঢুকে পড়ে অভিনয় করে ফেলেছেন। আবার হঠাৎই একদিন সেকালের দক্ষিণ কলকাতার শৌখিন অভিনেতা বিদ্যুৎ বসুর ডাকে ‘কেদার রায়’ নাটকে কার্ভালো-র চরিত্রে অভিনয় করে প্রথম রজনীতেই পুরস্কার পেলেন।
১৯৪৬ সালে তার কাছে ‘বার্মার পথে’ ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব আসে। ছবির পরিচালক হিরন্ময় সেন। ভিলেনের চরিত্র, নাম তুলসী। কিছু না ভেবে জেদের বশে অভিনয় করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। এই ভাবেই ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘পদ্মাপ্রমত্তা নদী’, ‘অ্যায়সা কিঁউ’ ও ‘বিশ রোজ কে বাদ’, ‘তথাপি’ ছবিতে কাজ করেছিলেন।
অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ ছবিটি তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ছিলেন ছবির সংগীত পরিচালক। সহকারী সলিল চৌধুরী আর সজল রায়চৌধুরী ছিলেন পরিচালকের সহকারী। এঁদের সঙ্গে পরিচয় সূত্রেই আইপিটিএ-তে যোগ দেন তিনি।
আইপিটিএ-তে যোগ দিয়ে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পরিচালনায় সলিল চৌধুরীর লেখা ‘শান্তি চাই’ পথনাটিকা করেন। এ ছাড়াও করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুক্তির উপায়’। ক্রমশ তিনি ‘নয়নপুর’, ‘সংকেত’, ‘ভাঙাবন্দর’, ‘বিসর্জন’ ‘দলিল’ নাটকে অভিনয় করেন।
এই সময় বন্ধু মনোরঞ্জন ঘোষ ‘বরযাত্রী’ ছবিতে গণশা চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। এই ছবির জনপ্রিয়তা কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাতারাতি তারকার পর্যায়ে নিয়ে যায়।
১৯৫২ সাল থেকেই তিনি সব দ্বিধা ঝেড়ে পেশাদার অভিনেতা হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করতে শুরু করেন। ‘জবানবন্দী’, ‘সিরাজদ্দৌলা’ ইত্যাদি চারটে ছবি মুক্তি পায় ওই বছরেই। সত্যেন বসুর ‘ভোর হয়ে এল’ মুক্তি পায় ১৯৫৩ সালে। আর পরের বছর তপন সিংহ তাকে নির্বাচন করেন তার প্রথম ছবি ‘অঙ্কুশ’-এর জন্য। তার পর ‘টনসিল’।
এরই মধ্যে অবশ্য ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’ ছবির জন্য শুটিং করেছেন। বারীন সাহার ‘তেরো নদীর পারে’ ছবিতে কাজ করেছেন। অজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেষ্টায় ‘রিক্সাওয়ালা’ ছবির কাজ শুরু হয়েছিল উৎপল দত্ত ও সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। ছবির নায়কের ভূমিকায় কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৫৬ সাল থেকে সংকটকাল কাটিয়ে কালীবাবু স্থিতু হন বাংলা নাটক ও সিনেমার নির্ভরযোগ্য চরিত্রাভিনেতা হিসেবে। একে একে সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, তপন সিংহর ছবিতে কাজ করতে শুরু করেন। ‘অযান্ত্রিক’, ‘কত অজানারে’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘লৌহকপাট’, ‘ডাকহরকরা’, ‘পরশপাথর’ ছবিতে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল।
কালী বন্দ্যোপাধ্যায় মুম্বই গিয়ে হিন্দি ছবিতেও কাজ করেছেন সত্তরের দশকে। নবেন্দু ঘোষের ‘ডগদরবাবু’, হৃষীকেশ মুখ্যোপাধ্যায়ের ‘বাবর্চি’, ‘সব সে বড়া সুখ’। কিন্তু সেখানে তার মন টেকেনি। ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়।
সব মিলিয়ে তিনি প্রায় দেড়শো ছবিতে কাজ করেছেন। নাটক করেছেন একত্রিশটি। তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অভিনেতা, পরিচালকেরা অবাক হয়েছেন চরিত্রের জন্য তার মনঃসংযোগ ও অভিনয় কুশলতা দেখে।
জীবনের শেষ ছবি ‘তান্ত্রিক’-এ অভিনয় করতে গিয়ে বৃষ্টিতে খুব ভিজতে হয়েছিল কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তা থেকেই ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৫ জুলাই ১৯৯৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
কালী বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২০ সালের আজকের দিনে (নভেম্বর) কলকাতার কালীঘাটে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment