জন্মদিনে স্মরণঃ কা ন ন দে বী
‘‘কী সুন্দর মুখ তোমার! গান করো?’ তাহলে একবার শান্তিনিকেতনে এসে গান শুনিয়ো আমায়।’’
[ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ]
বাবলু ভট্টাচার্য : সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব আর গুণ— এই তিনের দারুণ এক কম্বিনেশন ছিলেন কানন দেবী। তাঁকে বলা হয় ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম নায়িকা। শুধু তা-ই নয়, বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁকেই প্রথম তারকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রথম ‘ব্র্যান্ডেড’ নায়িকা কানন দেবী— এমনও বলেন কেউ কেউ; সুচিত্রা সেনের আগের ‘সুচিত্রা’ কানন দেবী। যদিও দুজনের যাপিত জীবন, পারিবারিক অবস্থা— কোনো কিছুরই মিল নেই।
আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’-তে অনেক কথা বলে গেছেন তিনি। তাঁকে নিয়েও অনেক গল্প প্রচলিত। মা-বাবা নেই, খাওয়াপরা নেই, ঝি-গিরি করে, দুয়ারে দুয়ারে মাথা ঠুকে কানন থেকে কানন বালা, তারপর কানন দেবী হওয়া বাংলা সিনেমার সবচেয়ে আশ্চর্য সাফল্যগাথা। তাঁর জীবনের গল্পটিই যেন অতি দুঃখের কোনো বাংলা সিনেমা। একের পর এক বাঁধা পেরিয়েছেন তিনি।
বাঁচার অবলম্বন হিসেবে যখন অভিনয়কে বেছে নিতে হলো, তখন অভিনয়কেই তিনি তাঁর জীবন, জীবিকা, ধ্যান ও জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। দারিদ্র্যের কারণে মাত্র ১০ বছর বয়সে, ম্যাডানের স্টুডিওতে গিয়ে অডিশন দিয়ে নির্বাচিত হন নির্বাক চলচ্চিত্র ‘জয়দেব’-এ অভিনয়ের জন্য।
জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত নির্বাক ছবি ‘জয়দেব’-এ রাধার ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে কানন দেবীর শিল্পীজীবন শুরু হয়। ১৯২৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর ছবিটি মুক্তি পায়। এরপর ১৯২৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ইন্ডিয়ান সিনেমা আর্টস প্রযোজিত এবং কালীপ্রসাদ ঘোষ পরিচালিত নির্বাক ছবি ‘শঙ্করাচার্য’-তে বালিকা কানন অভিনয় করেন। ১৯৩১ সালে প্রথম সবাক বাংলা ছায়াছবি ‘জামাইষষ্ঠী’ মুক্তি পায়।
‘ম্যাডান থিয়েটার’-এর দ্বিতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্য সবাক ছবি ‘জোরবরাত’-এর জন্য সুন্দরী ও সুকণ্ঠী নায়িকার প্রয়োজন। ছবির পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় কাননকে ডেকে পাঠালেন। কানন নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করলেন মিস কাননবালা নামে। এরপর ১৯৩১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ঋষির প্রেম’, ‘প্রহ্লাদ’ এবং ১৯৩২ সালে ‘বিষ্ণুমায়া’ ছবিতে অভিনয় ও গান করেন। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া।
আধুনিক গান ও রবীন্দ্রসংগীতে কানন দেবীর অসাধারণ দখল ছিল। কানন দেবীর গাওয়া ‘আমি বনফুল গো’, ‘তুফান মেইল যায়,’ ‘যদি ভালো না লাগে তো দিও না মন’, ‘ঘর যে আমাকে ডাক দিয়েছে’, ‘তোমারে ভুলতে পারিনা’, ‘ফেলে যাবে চলে যাবে তুমি জানি’- অথবা রবীন্দ্রসংগীত ‘আজ সবার রঙ্গে’ বা ‘তার বিদায়বেলার মালাখানি’ গানগুলো শুনলে বুঝা যাবে, কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি কত উঁচু দরের ছিলেন।
অবশ্য এই পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। এ পথে ছিল প্রেম, প্রলোভন, প্রবঞ্চনা। শোনা যায়, কানন দেবীর দারিদ্র্যের সুযোগ নিতেন পরিচালকেরা। সে সময়ে তাঁকে বহু সিনেমায় খোলামেলা দৃশ্যে (সে সময়ের বিবেচনায়) অভিনয় করতে হয়েছে। এত কিছুর পরও পরিচালকেরা তাঁকে আর্থিক দিক দিয়েও ঠকাতেন।
১৯৩৫ সালে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ সিনেমায় অভিনয় করে নিজেকে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত করেন কানন দেবী। এরপর ১৯৩৭ সালে ‘মুক্তি’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি সফলতার সিঁড়িতে পা রাখেন। এর পরের গল্প কেবল সাফল্যের। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি সাফল্য ধরে রেখেছিলেন। একের পর এক সুপারহিট সিনেমায় অভিনয় করে নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়।
অভিনয়ের পাশাপাশি ‘শ্রীমতি পিকচার্স’ নামে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও চালু করেন তিনি। এ ছাড়া তিনি নিজে পরিচালনার কাজও করেছেন। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে ৭০টির বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন কানন দেবী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘ঋষির প্রেম’, ‘প্রহ্লাদ’, ‘কংসবধ’, ‘বিষ্ণুমায়া’, ‘মা’, ‘কণ্ঠহার’, ‘বাসবদত্তা’, ‘পরাজয়’, ‘যোগাযোগ’, ‘মুক্তি’, ‘সাথী’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘পরিচয়’, ‘শেষ উত্তর’, ‘মেজদিদি’ প্রভৃতি।
১৯৪১ সালে নীতিন বসু পরিচালিত ‘পরিচয়’ ও এই ছবির হিন্দি সংস্করণ ‘লগন’-এ নায়িকা চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য বিএফজেএ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সম্মানে ভূষিত হন কানন দেবী।
এছাড়া ১৯৬৮ সালে চলচ্চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালে তিনি ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার পান। ১৯৯০ সালে তিনি সিনে সেন্ট্রাল কর্তৃক হীরালাল সেন পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯১ সালে কানন দেবী ‘ইন্দিরা গান্ধী স্মৃতি পুরস্কার’ পান।
২০১১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের ডাক বিভাগ কানন দেবীর একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে।
১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কানন দেবী ১৯১৬ সালের আজকের দিনে (২২ এপ্রিল) হাওড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment