Press "Enter" to skip to content

সুবিনয় রায় কেবলমাত্র একজন সুগায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন দক্ষ শিক্ষকও। তাঁর এই দ্বৈত পরিচয় তাঁকে সমকালীন গায়কদের চেয়ে আলাদা করে দিয়েছিল…….।

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ সুবিনয় রায়

তাঁর গলায় রবীন্দ্রগান জলের ঢেউয়ের তরল তান
মৃত সন্তানের দেহের সামনে দাঁড়িয়েও তিনি রবীন্দ্রনাথের গানের শুচিতাকে নষ্ট হতে দেননি! এমনই ছিল তাঁর রবীন্দ্রগানের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা…। তিনি সুবিনয় রায়।

বাবলু ভট্টাচার্য : বসুরায় পরিবারের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের মানিকগঞ্জের মালুচি গ্রামে। বাবা বিমলাংশুপ্রকাশ রায় ছিলেন একাধারে রসায়নবিদ ও সাহিত্যিক। সে কালের বিখ্যাত আমেরিকান বহুজাতিক সংস্থা ‘বার্ড কোম্পানি’র কলকাতার অফিসের চিফ কেমিস্ট। সাহিত্যপ্রীতি থাকার জন্য সুকুমার রায়ের ‘নন্‌সেন্স ক্লাব’-এর সদস্য ছিলেন তিনি।

মা সুখময়ীদেবী ছিলেন দার্শনিক পণ্ডিত সীতানাথ তত্ত্বভূষণের কনিষ্ঠা কন্যা। সীতানাথ ব্রাহ্ম আন্দোলনের একজন প্রধান স্থপতিও বটে। সুখময়ী ভাল গান গাইতেন। এস্রাজ বাজাতেন। মেডিক্যাল কলেজের মেয়েদের হস্টেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। পরে কিছু দিন শান্তিনিকেতনের মেয়েদের হস্টেল ‘শ্রীভবন’এর সুপার হিসেবেও যুক্ত হয়েছিলেন।

শৈশব ও কৈশোরে ব্রাহ্মসমাজের বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে সুবিনয়ের উপস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। সেই সব অনুষ্ঠানে গাওয়া গানের সুর তাঁর কানে আপনা থেকেই এসে পৌঁছত।

সুবিনয়ের পড়াশোনার শুরু মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে। সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে সিটি কলেজে ভর্তি হন আইএসসি পড়তে। কিন্তু সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহের কারণে অভিভাবকেরা তাঁকে শান্তিনিকেতনের ‘শিক্ষাভবন’-এ পাঠান আইএসসি পড়তে।

সময়টা ১৯৩৭/৩৮ সাল। তিনি যে ভাল গাইতেও পারেন, তা প্রথম আবিষ্কার করলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। তিনি রসায়নের শিক্ষক ছিলেন। রসায়ন বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তিনি সঙ্গীত ভবনে গান শেখাতেন। মজা করে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘কেমিক্যাল মিউজিশিয়ান’ বা ‘মিউজিক্যাল কেমিস্ট’ বলে ঠাট্টা করতেন। ফলে সুবিনয় ও শৈলজারঞ্জনের মধ্যে গুরুশিষ্যের সম্পর্কটা গান ও রসায়ন, দু’ধারাতেই বিস্তার লাভ করেছিল।

এ ছাড়া ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণীর (বিবিদি) কাছেও গান শিখেছিলেন সুবিনয় রায়। এঁরা ছাড়া শান্তিনিকেতনে আর যাঁর প্রভাব তাঁর উপর বেশি করে পড়েছিল বলে জানিয়েছেন সুবিনয়, তিনি হলেন সঙ্গীত ভবনের একদা অধ্যক্ষ সমরেশ চৌধুরী।

শান্তিনিকেতনে সুবিনয় রায়কে রবীন্দ্রনাথের গানের দিকে বেশি করে টেনে আনেন আর যে মানুষটি, তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। একদিন শৈলজারঞ্জন তাঁকে বললেন, “তুমি তো ভালই গানটান করো। ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠান হবে। সেখানকার রিহার্সালে তুমি ঢুকে পড়ো। গুরুদেব নিজে গান শেখাবেন উত্তরায়ণের ‘শ্যামলী’ আর ‘পুনশ্চ’য়।” সেই মহড়ায় সুবিনয় প্রথম দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে একেবারে সামনে থেকে।

বর্ষামঙ্গলের পর ১৯৩৯ সালে বিএসসি পড়ার জন্য সুবিনয় কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৩ সালে স্নাতক হন। ইতিমধ্যে ১৯৪১ সালে সিটি কলেজে অঙ্কের ক্লাস করতে করতে খবর পান, রবীন্দ্রনাথ নেই। সকলের সঙ্গে সে দিন সুবিনয়ও কলকাতার পথে হেঁটেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পরে তাঁর গানকে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে শৈলজারঞ্জনের অনুরোধে ও শুভ গুহঠাকুরতা ও সুজিতরঞ্জন রায়ের উদ্যোগে ৮ ডিসেম্বর ১৯৪১, ভবানীপুরের একটি ভাড়াবাড়িতে প্রতিষ্ঠা হয় শান্তিনিকেতনের বাইরে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার স্কুল ‘গীতবিতান’। অনাদি দস্তিদারের অনুরোধে এই প্রতিষ্ঠানের শাখা খোলা হয় উত্তর কলকাতায় সুবিনয় রায়ের ১ ভুবন সরকার লেনের বাড়িতে। দায়িত্বভার নিতে হয়েছিল সুবিনয় রায়কেই।

১৯৪৫ সালে সুবিনয় চাকরি নেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ‘স্টাটিসটিক্যাল ল্যাবরেটরি’তে। যেখান থেকে প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫৩ সালে ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট’ নামে পরিচিত হয়ে বরাহনগরের প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের বাড়ি ‘আম্রপালী’-তে চলে আসে। ১৯৪৫ সাল থেকে তাঁর কর্মজীবনের পাশাপাশি সঙ্গীত শিক্ষার পরবর্তী পর্যায়েরও সূচনা হয়। রবীন্দ্রনাথের গান শুধু গলায় তোলা নয়, তাকে বোঝা ও আত্মস্থ করার শুরু এই সময় থেকেই।

ওই বছরেই সুবিনয়কে কলকাতার রেডিয়ো স্টেশনে নিয়ে যান সুরেশ চক্রবর্তী অডিশন দেওয়ার জন্য। সুরেশ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় তিনি গেয়েছিলেন শচীনদেব বর্মনের একটি আধুনিক গান, ‘গোধূলির ছায়াপথে’ ও রবীন্দ্রনাথের ‘ওই মালতীলতা দোলে’।

১৯৪৫ সালেই সুবিনয়ের প্রথম রেকর্ড বেরোয় অনাদিকুমার দস্তিদারের পরিচালনায় কলম্বিয়া কোম্পানি থেকে। তিনি গেয়েছিলেন দু’টি গান, ‘এই করেছ ভালো’ ও ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে’। পরের বছর ১৯৪৬-এ দ্বিতীয় রেকর্ড বেরোয় ‘এলেম নতুন দেশে’ ও ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’।

সুবিনয় রায় কেবলমাত্র একজন সুগায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন দক্ষ শিক্ষকও। তাঁর এই দ্বৈত পরিচয় তাঁকে সমকালীন গায়কদের চেয়ে আলাদা করে দিয়েছিল। এর পিছনে সাঙ্গীতিক পরিবেশ ক্রিয়াশীল ছিল।

গোটা চল্লিশের দশক জুড়ে সুবিনয়কে প্রধানত শিক্ষক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে দেখা যায়। শান্তিনিকেতনের ‘সংগীত ভবন’, কলকাতার ‘গীতবিতান’, ‘দক্ষিণী’, ‘গীতবীথি’ (নিজের স্কুল) প্রতিষ্ঠানে গান শিখিয়েছেন।

অবশেষে ৯ জানুয়ারি, ২০০৪ তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

সুবিনয় রায় ১৯২১ সালের আজকের দিনে (৮ নভেম্বর) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.