———-জন্মদিনে স্মরণঃ সুপ্রীতি ঘোষ———–
বাবলু ভট্টাচার্য : শিউলির গন্ধের মতোই তাঁর গানের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেবীপক্ষের সূচনা। মহালয়ার ঊষা লগ্নে যখন রেডিওয় ঘরে ঘরে ধ্বনিত হয় ‘আলোর বেণু’ সেই সুরে আজও যেন মেতে ওঠে বাঙালির ত্রিভুবন। শুধু মহালয়ার সেই প্রভাতী অনুষ্ঠানই বা কেন? রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে নজরুলগীতি কিংবা ভজন থেকে আধুনিক গানে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তিনি মাতিয়েছেন অসংখ্য গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের। তিনি সুপ্রীতি ঘোষ। বাড়ির সকলে তাঁকে ‘পানসি’ বলে ডাকতেন। বাড়িতে ছিল সঙ্গীতের পরিবেশ। তাঁর বাবা ডাঃ রবীন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন সঙ্গীতানুরাগী। জ্যাঠামশাই নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানির বিশেষ দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে সে কালের খ্যাতনামা শিল্পীদের ছিল ওঠাবসা। মির্জাপুর স্ট্রিটের সেই বাড়িতে যাতায়াত ছিল পঙ্কজকুমার মল্লিক, কাননদেবী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, রাইচাঁদ বড়াল, রাধারানি দেবীর মতো শিল্পীদের। আর বাড়িতে গান বাজনার পরিবেশ থাকায় ছোটবেলা থেকেই সুপ্রীতিও আপন মনে গান গাইতেন।

এমনই এক দিন আপন মনে গান করছেন, এমন সময় সেই গানের সুর পৌঁছেছিল বৈঠকখানায় উপস্থিত রাইচাঁদ বড়ালের কানে। তিনি জানতে চেয়েছিলেন কে গান করছে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পঙ্কজ মল্লিকও। তখন নৃপেন্দ্রবাবু বললেন তাঁর ভাইজি সুপ্রীতি গান করছে। রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজ মল্লিক নৃপেন্দ্রবাবুকে বললেন, রেডিওয় সুপ্রীতির গান গাওয়ানোর কথা। সেই জ্যাঠামশাইয়ের হাত ধরেই গার্স্টিন প্লেসের স্টুডিওয় সুপ্রীতি দেবীর পদার্পণ। গেয়েছিলেন দু’টি গান— রবীন্দ্রনাথের ‘সন্ধ্যা হলো গো মা’ এবং শৈলেন দাশগুপ্তের সুরে একটি আধুনিক গান। প্রথম গান গেয়ে পেয়েছিলেন পাঁচ টাকা।১৯৩৪ সালে সেনোলা রেকর্ড কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম গানের রেকর্ড। তাতে ছিল একটি কাব্য সঙ্গীত এবং একটি কীর্তন। এর পরে পাইওনিয়র রেকর্ড কোম্পানি থেকে মান্না দে-র সুরে রেকর্ড করেছিলেন ‘বালুকা বেলায় অলস খেলায়’, ‘ওগো সুখের ধ্যানে’ গান দু’টি।

পরে ১৯৪১ সালে তিনি রেকর্ড করেছিলেন দু’টি রবীন্দ্রনাথের গান— ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ ও ‘কে বলে যাও যাও’। শোনা যায়, এই রেকর্ডটির জন্য রবীন্দ্রনাথ সুপ্রীতি দেবীকে আশির্বাদ পাঠিয়েছিলেন। ১৯৪১-এ চলচ্চিত্রের নেপথ্যে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ‘অভয়ের বিয়ে’ ছবিতে। এর পরে অসংখ্য ছবিতে নেপথ্যে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে গান গেয়েছেন তিনি। তার মধ্যে ‘দৃষ্টিদান’, ‘স্বামীর ঘর’, ‘নতুন খবর’, ‘তথাপি’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘সুনন্দার বিয়ে’, ‘কপালকুণ্ডলা’ উল্লেখযোগ্য। সুপ্রীতি দেবীর লেখাপড়া প্রথমে ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে, পরে আশুতোষ কলেজে। গান শিখেছিলেন বাসন্তী বিদ্যাবীথিতে। রবীন্দ্রসঙ্গীত, কীর্তন, নজরুলগীতি, মার্গসঙ্গীত এবং আধুনিক গানের তালিম নিয়েছিলেন। তবে নানা ধরনের গানের তালিম নিলেও রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর জীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।

১৯৪৬ সাল থেকে আকাশবাণীর বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে সুপ্রীতি দেবীর গান গাওয়া শুরু। এই অনুষ্ঠানে তাঁর গাওয়া গান আজ ইতিহাস। ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ গানটির মধ্য দিয়েই যেন মহালয়ার সকালে সূর্যের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়ে বাংলার আকাশে বাতাসে। গানটি ১৯৭৪ সালে রেকর্ড করা হয়েছিল।
২০০৯ সালের ২২ এপ্রিল সুপ্রীতি দেবী মৃত্যুবরণ করেন।
সুপ্রীতি ঘোষ ১৯২২ সালের আজকের দিনে (২৮ আগস্ট) মধ্য কলকাতার মির্জাপুর স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment