স্মরণঃ সু চি ত্রা সে ন
বাবলু ভট্টাচার্য : সালটা ছিল ১৯৭৯। জনজীবনের কোলাহল থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলেন। কোন অভিমানে, জানা নেই কারও। পিছুহটা জীবনের কোনো গ্লানির খবর কাউকে জানতেও দেননি। বুঝতে দেননি কী ছিল অভিমান? জানতে দেননি তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণে জমা হয়েছিল কিনা বেদনার ছোপছোপ চিহ্ন। এমনকি জনসমক্ষে আসা এড়াতে এই দেশের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘দাদাসাহেব ফালকে’ও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন।
১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের পাবনায় জন্ম নেওয়া এ অভিনেত্রীর আসল নাম রমা দাশগুপ্ত। তাঁকেই বলা হয় সর্বকালের সেরা বাঙালি অভিনেত্রী।
গোধূলির আলোর মতো তাঁর জ্যোতিময় আর মার্জিত সৌন্দর্যে মায়াময় হাসি যেন লিওনার্দোর অপূর্ব সৃষ্টি। প্রাণবন্ত রোমান্টিক অভিনয়ে অনবদ্য বলেই অতুলনীয় হয়ে কেড়ে নিয়েছিলেন কোটি কোটি দর্শকের হৃদয়। অথচ তখনো বহু দর্শকের অজানা ছিল, বাল্যবিয়ের চক্করে পড়েছিলেন এ মহানায়িকা।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সপরিবারে পাড়ি জমিয়েছিলেন কলকাতায়। সেখানেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল তৎকালীন বিখ্যাত শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে। যদিও এ বিয়ের কারণেই সুচিত্রার সিনেমায় পা রাখা।
অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর স্বামী পরিচয় করিয়ে দেন সে সময়ের আইকনিক সিনেমা নির্মাতা বিমল রায়ের সঙ্গে। আর ঘটনাক্রমে বিমল রায় ছিলেন আদিনাথ সেনের প্রথম স্ত্রীর ভাই।
বিমল রায়ের হাত ধরেই সুচিত্রার পরিচয় হয় আরেক বিখ্যাত পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্তের সঙ্গে। ১৯৫৩ সালে একটি আনুষ্ঠানিক স্ক্রিন টেস্টের পর ‘সাত নম্বর কয়েদি’ সিনেমায় সুযোগ করে দেন তিনি। এ সময়ই রমার নাম বদলে সুচিত্রা সেন রেখেছিলেন সুকুমার।
একই বছর মুক্তি পাওয়া ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ সিনেমায় বিষ্ণুপ্রিয়া চরিত্রটি তাঁকে এনে দিয়েছিল তারকাখ্যাতি।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। একের পর দুর্দান্ত সব সিনেমা উপহার দিতে থাকেন। অভিনয়ে তিনি এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের একটি সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস অবলম্বনে ‘দেবী চৌধুরানী’ নামের সে সিনেমাটি আর নির্মিত হয়নি। একই কারণে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রাজকাপুরের একটি সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাবও।
সুচিত্রা সেন অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘মরণের পরে’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘দেবদাস’, ‘শাপমোচন’, ‘সবার উপরে’, ‘সাগরিকা’, ‘হারানো সুর’, ‘পথে হলো দেরি’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘সপ্তপদী’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘উত্তর ফাল্গুনি’, ‘হার মানা হার’ প্রভৃতি।
মাত্র ২৫ বছর অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। ক্যারিয়ারের ৬০ ছবির ৩০টিতেই তাঁর জুটি ছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার।
সুচিত্রা সেনের আন্তর্জাতিক সাফল্য ১৯৬৩ সালে আসে, যখন তিনি ‘সাত পাকে বাঁধা’ সিনেমার জন্য মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছিলেন। এ পুরস্কার অর্জনে তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয়।
ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছিলেন ১৯৭৮ সালে। জানা গেছে, আড়ালে যাওয়ার পর মন দিয়েছিলেন ধর্মকর্মে।
সুচিত্রা সেন ২০১৪ সালের আজকের দিনে (১৭ জানুয়ারি) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment