জন্মদিনে স্মরণঃ সু কু মা র রা য়
“পরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে,
পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছনাতে।”
(ছড়া : ভূতের খেলা – সুকুমার রায় )
বাবলু ভট্টাচার্য : আপনার বয়স কত? দশ, বিশ, ত্রিশ? তাতে কোনো সমস্যাই নেই। আপনি যদি ষাট বছরের বৃদ্ধও হন তাতেও কিচ্ছু যায় আসে না, আপনি এখনই স্বচ্ছন্দে সুকুমার রায়ের যেকোনো লেখা নিয়ে পড়া শুরু করতে পারেন। আপনি একটুও বিরক্ত হবেন না, আপনার কাছে কখনো দুর্বোধ্য ঠেকবে না।
বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায়ের তুলনা কেবল সুকুমার রায়ই। শিশুসাহিত্য, হাস্যরসে তো বটেই, বিদ্রূপের সুরে সমাজের নানা অসঙ্গতির কথা বলতে পারাতেও তিনি অনন্য ও অসাধারণ।
সুকুমার রায় মূলত শিশুসাহিত্যিক ছিলেন; কিংবা বলা যায় সুকুমার রায় কেবল শিশুসাহিত্যিকই ছিলেন। শিশুদের জন্য তিনি লিখেছেন ছড়া, গল্প, নাটক, জীবনীসহ আরও অনেক কিছু। এর বাইরেও লিখেছেন ‘বিবিধ বিষয়’, যা মূলত শিশু- কিশোরদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা জানা-অজানা তথ্য গল্পাকারে বলার প্রয়াস, এবং বলা বাহুল্য, এই প্রয়াসেও তিনি সফল।
গুরুজনদের উপদেশ শুনতে কারোই ভালো লাগে না। কিন্তু উপদেশ যদি দেন সুকুমার রায়, তবে না শুনে উপায় কী! শিশুদের শেখাতে গিয়ে সুকুমার রায় গল্প বলেছেন, ছড়া বলেছেন। গুরুজনদের কাঠখোট্টা উপদেশের বাইরে এসে গল্প-কবিতার ছলে শিখিয়েছেন কী করা উচিত এবং কী অনুচিত।
পেন্সিল কামড়ানো কিংবা সিঁড়ি দিয়ে ধুপধাপ করে নেমে জুতা ছিঁড়ে ফেলা একদম ভালো কাজ নয়- এ উপদেশ দিতে গিয়ে সুকুমার রায় লিখে ফেলেছেন একটা আস্ত গল্প ; নাম ‘যতীনের জুতো’। কাউকে হিংসে না করার উপদেশ দিতে গিয়ে লিখেছেন ‘হিংসুটি’। এসব গল্প পড়ে শিশুরা আনন্দ পাবে, হেসে লুটোপুটি খাবে। কিন্তু তারা শিখবে। নিজেরাই বুঝে নেবে তাদের কী করতে হবে।
বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী মারা যাওয়ার পর বিখ্যাত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার ভার নেন সুকুমার রায়। ‘সন্দেশ’-এর সম্পাদনার ভার নেয়ার পরই সুকুমার রায় পূর্ণোদ্যমে লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর লেখালেখির বড় অংশই ‘সন্দেশ’ পত্রিকার জন্য।
বাংলা ভাষায় প্রথম ননসেন্স ছড়া লেখেন সুকুমার রায় এবং ননসেন্স ছড়ার জন্যই সুকুমার রায় সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। প্রসঙ্গত, ননসেন্স ছড়া হচ্ছে একধরনের ছড়া যা মূলত কৌতুক বা হাস্যরসের জন্য লেখা হয়। কলেজে পড়ার সময় তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘ননসেন্স ক্লাব’। এই ক্লাব থেকে ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ নামে আরেকটি পত্রিকা বের হতো।
ননসেন্স ক্লাবের মতোই আরও একটি ক্লাব গড়ে তোলেন সুকুমার রায়; নাম ‘মণ্ডা ক্লাব’। ‘মণ্ডা ক্লাবের কয়েকটি আমন্ত্রণ পত্র’ সিরিজের কয়েকটি কবিতাও আছে তাঁর।
সুকুমার রায়ের সবচেয়ে মজার দিক হচ্ছে তাঁর ছড়া। শিশুদের জন্য লিখলেও তাঁর ছড়া এতটাই প্রাণবন্ত যে সেসব ছড়া বড়দের মুখে মুখেও ঘোরে। সুকুমার রায় তাঁর ছড়ায় শব্দ নিয়ে খেলেছেন, যেমন খুশি তেমন গড়েছেন। তাঁর ছড়া বা কবিতা যেমন বড়দের পড়ার বা বোঝার মতো ভারিক্কি নয়, তেমনি আবার কেবল ছোটদের জন্য লেখা হালকা চালেরও নয়।
তাঁর ছড়ার বই ‘আবোল তাবোল’-এ এমন অনেক ছড়া আছে যেগুলো কেবল আনন্দের জন্যই লেখা। সুকুমার রায় ‘হাঁসজারু’, ‘বকচ্ছপ’, ‘হাতিমির’ মতো অদ্ভুত কিম্ভূতকিমাকার কাল্পনিক প্রাণীর জন্ম দিয়েছেন তাঁর ‘খিচুড়ি’ ছড়ায়।
আর তাঁর ‘বাপুরাম সাপুড়ে’ পড়েননি বা শোনেননি এমন বাঙালি সম্ভবত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সুকুমার রায়ের আরো অনেক বিখ্যাত ছড়া আছে। তার মধ্যে ‘গোঁফচুরি’, ‘প্যাঁচা আর প্যাঁচানি’, ‘অবাক কাণ্ড’, ‘ন্যাড়া বেলতলায় যায় ক’বার’, ‘শব্দ কল্প দ্রুম’, ‘একুশে আইন’, ‘ভুতুড়ে খেলা’, ‘রামগরুড়ের ছানা’, ‘মূর্খমাছি’, ‘জীবনের হিসাব’ উল্লেখযোগ্য।
সুকুমার রায়ের লেখায় রসবোধ ছিল প্রবল। তিনি বাংলা ননসেন্স কবিতার জনক হলেও কেবল কবিতা নয়, তাঁর সব লেখা পড়েই মনে হয় তা ননসেন্স শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। তাঁর আগে বাংলা সাহিত্যে এই ঘরানার কবিতা কেউ তো লেখেননি, এমনকি সুকুমার রায়ের পরেও এই ধরনের কবিতা কেউ খুব একটা লেখেননি।
মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে ‘আবোল তাবোল’ ছেপে বের হওয়ার নয় দিন আগে সুকুমার রায় এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান; ব্যাধির নাম ‘কালাজ্বর’।
সেই জ্বরে আক্রান্ত সুকুমার রায় ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ১০০ নং গড়পার রোড, কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
সুকুমার আর সুপ্রভার বিবাহের আট বছর পরে অর্থাৎ ১৯২১ সালের ২ মে (১৮ বৈশাখ ১৩২৮) তাঁদের একমাত্র সন্তান ‘মানিক’ অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়-এর জন্ম হয়।
সুকুমার রায় ১৮৮৭ সালের আজকের দিনে (৩০ অক্টোবর) কলকাতার কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment