গীতশ্রী সাহা : ১৩ নভেম্বর, ২০২১। আজকাল সাহিত্যের জগতে বেশ কিছু তথাকথিত সাহিত্যিক নামধারী ব্যক্তিবর্গের আবির্ভাব ঘটেছে, এবং এই সাহিত্যিক নামধারী লোকের সংখ্যা এখন ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে । কারণ এই তকমাটি অর্জন করতে নিজের মগজ ধোলাই করে অং বং কবিতার মত সেরকম কিছু তৈরী করার প্রয়োজন পড়ে না। যে ব্যক্তিদের হাতে বেশ কিছু অর্থ ও সময় আছে আর খুব সহজেই নাম অর্জনের ইচ্ছা আছে, তাঁরা অতি যত্নসহকারে একটা লাইব্রেরিতে গিয়ে পার্টিকুলার যে মণীষীর ওপর কিছু বই বের করতে চান, সেই লাইব্রেরি থেকে সেই মণীষীদের ওপর লেখা বেশ কিছু বইয়ের কালেকশন পেয়ে যান। এইবার চলে কপি ও পেস্ট করার কাজ। কিছুটা হুবহু বই অথবা কিছুটা নিজের মত করে লিখে একটা ম্যাটার দাঁড় করান। সেগুলো যত্ন সহকারেই কপি করা চলে । ওটাই যা পরিশ্রমের কাজ। কারণ টুকলিও একটা আর্ট “যদি না পড় ধরা”। এনারা আবার বহু অনুষ্ঠানে যান। সাহিত্য যা অতি নিভৃতে নির্জনে সাধনার জায়গা তা এনাদের থেকে বহু দূরে। কারণ অনুষ্ঠানে যত যাবেন তাঁকে চিনবে মানুষ তথাকথিত কবি বা সাহিত্যিক হিসেবে। ফলে কপি পেস্ট ও কিছুটা নিজের ভাষা সংযোগ এবং সঙ্গে নানা অনুষ্ঠানে যাওয়া সমান্তরালে চলতে থাকে।
এর ফলস্বরুপ বইগুলো এমন দাঁড়ায় যে তাঁদের বইতে যে মণীষী সম্পর্কে যেসব তথ্য লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে, সেই তথ্যের মধ্যে এই তথাকথিত সাহিত্যিকদের নিজের কোনো বক্তব্য পেশ করা হয় না বা কোনো গবেষণার নিদর্শন থাকে না। থাকে শুধু কপি আর পেস্ট লব্ধ উপাদান। অথচ বাইরের জগতে এনারা নিজেদের টুকলি করা উপাদানকে গবেষণা বলে চালিয়ে দেন । আগেকার সমালোচক বা লেখকরা যাঁরা বছরের পর বছর পরিশ্রম করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে সরোজমিনে তা লক্ষ্য করে ও প্রচুর অধ্যায়নের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য কষ্টসাধ্য পরিশ্রম করে যা একত্রিত করেছেন ও তাঁদের পরিশ্রমের ফসল একটি বই আকারে যাঁরা লিপিবদ্ধ করেছেন, তাঁদের করে যাওয়া পরিশ্রমের ফসলকেই এই সাহিত্যিক নামধারী ব্যক্তিরা নিজের নামে লিপিবদ্ধ করছেন। ফলস্বরূপ এই সাহিত্যিক নামধারীদের বইগুলোতে না তো নতুন কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে দেখা যাচ্ছে, না কোনো নতুন বিষয় সংযোজন বা নিজেদের নতুন কোনো অভিমত প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে। ফলে কতগুলো ফেনার বুদবুদ ছাড়া আর নতুন কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই সাহিত্যিক নামধারী লেখকদের বেশ কিছু বই বেরিয়ে যাচ্ছে। অর্থ থাকলে ভূতের বাবারও শ্রাদ্ধ হয়। পরিশ্রম শুধু কপি আর পেস্ট। এরপর কম্পোজ ও প্রিন্ট, ওতে যতটুকু সময় লাগে এই যা । ফলে বিশেষ কোনো নতুনত্ব উপাদান এখানে দেখা যায় না।
এবার এইসব ব্যক্তিদের তোল্লাই দিচ্ছেন কারা? লাখ টাকার প্রশ্ন এখানে। এনাদের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে আসছেন সাহিত্যের জগতে একটু ওপরের দিকে অবস্থান করছেন এমন কিছু মানুষ যাঁদের কিছু অর্থ প্রদান ও প্রধান অথিতির জায়গা দিয়ে এইসব সাহিত্যিকদের দল তাঁদের বই প্রকাশ করছেন। আর বাকিরা কারা যাচ্ছেন? বাংলায় ও বাঙালিদের মধ্যে টুকিটাকি লেখেন এমন মানুষের অভাব নেই । ফলতঃ কিছু অর্থ ব্যয় করে একটা হল ভাড়া করে, ছোট একটি মেমেন্টো কিংবা মেডেল বা ডিজিটাল সার্টিফিকেট কিংবা শুধুমাত্র একটা মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিলেই হল ভরানোর মানুষের অভাব হয় না । এনাদের বই কিছু লাইব্রেরিতেও যাচ্ছে, লাইব্রেরির কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞেস করছেন না যে নতুন কি সংযুক্ত আছে সেই বইটাতে। ফলে এনারা অবাধে মাছের তেলে মাছ ভেজে চলেছেন ও সাহিত্যিক নামক তকমা গায়ে লাগিয়ে ঘুরছেন। সাহিত্যের জগত তাহলে কোন দিকে চলেছে সেটাই প্রশ্ন জাগে মনে। নতুন কিছু নিয়ে লেখার হিম্মত এই তথাকথিত সাহিত্যিকদের কলমে আসছে না টুকলি বিদ্যা করা ছাড়া। সাধারণ মানুষ কোনো বিষয়কে তলিয়ে দেখার চেষ্টাও করেন না। তারা না জেনে না পড়ে যা শুনছেন তাতে গা ভাসিয়ে চলছেন। আর অন্যদিকে একটু ওপরে থাকা কবি ও সাহিত্যিকরা কিছু অর্থ ও সম্মান পাওয়ার আশায় দিব্যি সেই বই উদ্বোধন করে চলেছেন।
হিম্মত থাকলে আধুনিক ও বাস্তবে ঘটে চলা ঘটনা বা আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার ওপর এইসব নামধারী তথাকথিত সাহিত্যিকদের দল নিজেদের কিছু মৌলিক রচনা সৃষ্টি করে দেখান। নতুন কি উপহার দিচ্ছেন এই তথাকথিত সাহিত্যিক নামধারী মানুষরা মিথ্যা নাম উপার্জন করার নেশায়, আর তাঁদের এই প্রশ্ন করার মানুষরাই বা কোথায়, সেটাই এখন বড় একটা প্রশ্ন চিহ্ন।
ছবি – সৌজন্যে গুগুল।

Be First to Comment