Press "Enter" to skip to content

সত্যজিত রায়ের অন্যতম প্রিয় অভিনেতা কামু মুখার্জি। প্রথম কাজ করার সুযোগ মিলেছিল ‘চারুলতা’ ছবিতে, ভূপতির বন্ধুর ভূমিকায় একটিমাত্র দৃশ্যে………

Spread the love

বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, আসলে মন্দার বোসের উপস্থিতি ছাড়া পুরো ‘সোনার কেল্লা’ ছবিটাই ফিকে। ধর্মতলা থেকে কেনা সস্তার লেদার জ্যাকেট আর বাটার জুতো, তাও আবার পরের দ্রব্য, সেই পরেই আদ্যোপান্ত একটি বর্ণময় চরিত্রকে পর্দায় যিনি জীবন্ত করে তুললেন তিনি কামু মুখোপাধ্যায়। এক অসামান্য অভিনেতা, যিনি যে কোনও চরিত্রে, যে কোনও পরিসরে নিজেকে মেলে ধরতে পারতেন অনায়াসে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তিনি তাঁর সমস্ত অভিনয় জীবনে ছোটবড় নানান চরিত্রের ভিড়ে মাত্র একটি ছবিতেই মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পেলেন। চলচ্চিত্রে কামু মুখোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ সম্ভবত ১৯৫৯ সালে ‘সোনার হরিণ’ ছবিতে, আবদাল্লার চরিত্রে। আগাগোড়াই স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণবন্ত এই অভিনেতা একদিন নিজেই হাজির হয়ে যান সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। নিজের পরিচয় দিয়ে জানান তিনি সত্যজিতের ছবিতে কাজ করতে চান। ব্যস, এইটুকু বলেই তিনি উধাও। সত্যজিৎ কৌতুহলবশে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, আগন্তুক সিনেমাপাড়ায় যাতায়াত করেন, ছোটখাটো যে কোনও চরিত্র পেলে কাজ করে থাকেন।সত্যজিতের সঙ্গে কামুর প্রথম কাজ করার সুযোগ মিলল ‘চারুলতা’ ছবিতে, ভূপতির বন্ধুর ভূমিকায় একটিমাত্র দৃশ্যে। শোনা যায় কামু একটু হতাশ হয়েছিলেন এত ছোট চরিত্র পেয়ে। কিন্তু পরিচালক তাঁকে বলেন, ছোট চরিত্রে নিজেকে ফুটিয়ে তোলার মধ্যেই আসল অভিনেতার দক্ষতা রয়েছে। সম্ভবত সেই কথাটিকেই তাঁর জীবনের মূল মন্ত্র করেছিলেন কামু। ভূপতির বাড়িতে এক ঘরোয়া পার্টির দৃশ্যে, চশমা ঠিক করতে-করতে বিশ্ববন্ধু পত্রিকায় চারুলতার লেখা দেখার একটি শট দিয়েছিলেন কামু। জহুরী জহর চিনতে ভুল করেননি। ওই একটি শটেই সত্যজিৎ বুঝে গিয়েছিলেন কি অসামান্য এক অভিনেতার হদিশ পেয়েছেন তিনি। ছোটবড় যে কোনও চরিত্রে কামু ছিলেন অনবদ্য এবং অপ্রতিরোধ্য। এরপর একে একে তাঁকে দেখা যায় ‘কখনো মেঘ’, ‘কমললতা’, ‘মৌচাক’, ‘স্বয়ংসিদ্ধা’, ‘হংসরাজ’, ‘পাকা দেখা’, ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো’ ও আরও অনেক ছবিতে। তবে সত্যজিতের ছবিতেই তাঁর অভিনয় দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছিল সব থেকে বেশি। অভিনেতা হিসেবে কাজ করেছেন ‘নায়ক’, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘শাখা প্রশাখা’ ছবিতে। মন্দার বোসের চরিত্র ছাড়া কামুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিনয় সন্দীপ রায়ের ‘ফটিকচাঁদ’ ছবিতে, যেখানে তিনি ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। তবে কামুর তিনটি সেরা অভিনয় বেছে নিতে হলে ‘ফটিকচাঁদ’ আসবে দু’নম্বরে।

একে অবশ্যই মন্দার বোস। ওরকম একটি ভয়ঙ্কর চরিত্র, যে কি না কাঁকড়া বিছে ধরতে পারে, কনকনে ঠাণ্ডায় চলন্ত ট্রেনের হিমশীতল লোহার হাতল ধরে ঝুলে-ঝুলে এক কামরা থেকে অন্য কামরায় চলে যেতে পারে, আবার ঠাণ্ডা মাথায় একটা লোককে ধাক্কা মেরে পাহাড় থেকে ফেলেও দিতে পারে। এই বেপরোয়া ডাকাতটি আবার ট্রেনে বসে সাপলুডো খেলে, মজার-মজার ম্যাজিক দেখিয়ে যা খুশি ভ্যানিশ করে দিতে পারে। এতরকম রঙে রঙিন একটা চরিত্র, বোধহয় এক কামু মুখার্জি ছাড়া আর কারোর পক্ষেই পর্দায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব ছিল না। সত্যিই নাকি খালি হাতে কাঁকড়া বিছেটি ধরেছিলেন কামু, যদিও সত্যজিৎ ছবি থেকে সেই দৃশ্যটি বাদ দেন। পরিচালকের যুক্তি ছিল, এতে মন্দার বোস যে ফেলুদার থেকে বেশি সাহসী, সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে। তা কখনওই হতে দেওয়া যায় না। বলা বাহুল্য, দৃশ্যটি বাদ পড়ায় আশাহত হয়েছিলেন কামু। তেমনই ‘ফটিকচাঁদ’ ছবিতে হারুন-অল-রশিদের ভূমিকায় দক্ষ বাজিকরের চারিত্রিক বলিষ্ঠতা তথাকথিত ভদ্রলোককেও লজ্জায় ফেলে দেয়। বাংলা ছবির ইতিহাসে একেবারেই ব্যতিক্রমী এই চরিত্রে অসামান্য রূপদান করেছিলেন কামু। এরপরেই আসবে ‘নায়ক’-এ প্রীতিশ সরকারের চরিত্রটি, সে যুগের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত বাঙালি যে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে চায় যে কোনও মূল্যে। একদিকে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ অন্যদিকে লাগামছাড়া উচ্চাশা– এই দুইয়ের টানাপোড়েনকে পরিমিত অভিনয়ের মোড়কে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন কামু।

এই চরিত্রটিতে শহুরে মধ্যবিত্তের মেজাজ এমনভাবে রয়েছে যেখানে অন্য পরিচালক হলে হয়তো অন্য কোনও অভিনেতার কথা ভাবতেন। কিন্তু এখানেই সত্যজিতের তুরুপের তাস ছিলেন কামু। একেবারেই অন্য ধরণের একটি চরিত্র, যে ভূমিকায় দর্শক তাঁকে সেভাবে দেখেনি, সেখানেই তিনি সুযোগ দিলেন কামুকে। কতটা দক্ষতার সঙ্গে উতরে দিয়েছিলেন তিনি, তা ছবিটি না দেখলে বলে বোঝানো অসম্ভব। এছাড়া ‘হংসরাজ’ ছবিতেও তাঁর অভিনয় মনে রাখার মতো। গুপি-বাঘা সিরিজ়ের ছবিগুলিতে একাই পাঁচ-ছয়টি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কামু। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এ সত্যজিৎ তাঁকে দিয়ে গানও গাইয়েছিলেন। ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’ গানটিতে প্লে-ব্যাক করেছিলেন কামু ও জহর রায়। ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে কোষাগারের দ্বাররক্ষীর ভূমিকায় একটি দৃশ্যে তিনি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সোজা মাটিতে পড়ে যান, যা সজ্ঞানে করা বেশ কঠিন। এমন সব ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা কামুর কাছে ছিল জলভাত। আর কেই বা ভুলতে পারবে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবির একটিমাত্র দৃশ্যে অর্জুনের ভূমিকায় তার নাইফ থ্রোয়িংয়ের খেল। কামুর তখন স্বাস্থ্যবান চেহারা। কিন্তু সত্যজিৎ তাঁকে দিয়ে অভিনয় করালেন এক বৃদ্ধের ভূমিকায়। চাকু ছোঁড়ার খেলা দেখানোর আগে মগনলালের প্রশ্ন, ‘খেল দিখা সকোগে না?’ রোগভারে ন্যুব্জ অর্জুনের নির্লিপ্ত উত্তর, ‘থোড়া বুখার হ্যায়, ফির ভি কোই বাত নেহি।’ এই সংলাপ আর তার পরবর্তী দৃশ্য ভোলার নয়। অভিনয় ছাড়াও নানান ব্যাপারে উৎসাহী মানুষ ছিলেন কামু মুখার্জি। সত্যজিতের বহু ছবিতে ছোটখাটো চরিত্র করার পাশাপাশি ফিল্ম ইউনিটের একজন অপরিহার্য সদস্য হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কাজ করতেন টেকনিশিয়নদের সঙ্গে। আদ্যন্ত আমুদে মানুষ কামু, শ্যুটিংয়ের ফাঁকে পুরো ইউনিটকে মাতিয়ে রাখতেন তাঁর নিত্য নতুন মজা আর দুষ্টুবুদ্ধি দিয়ে। তাঁর রসবোধ ছিল প্রবল।

নিজের আমুদে স্বভাবের গুণে এমনভাবে সকলের মন জয় করতেন তিনি যে স্বয়ং সত্যজিৎ বলেছিলেন তাকে নিয়ে একটা গোটা বই লেখা যায়। এমন অভিনেতা বিদেশে জন্মালে তার সঠিক মুল্যায়ন হত হয়ত। কিন্তু এই বাংলায় তাঁর প্রতিভার যোগ্য সমাদর পাননি কামু। সত্যজিৎ ছাড়া আর কেউই তাঁকে সেভাবে ব্যবহার করেননি। শেষ বয়সে অর্থকষ্ট গ্রাস করেছিল তাঁকে। বহু বছর ধরে বাতে পঙ্গু হয়ে শেষ জীবনটা একেবারেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন সোনার কেল্লার দুর্ধর্ষ ভিলেন।

২০০৩ সালে ৬ ডিসেম্বর ৭২ বছর বয়সে, বেলেঘাটা সিআইটি রোডের বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান অভিনেতা।

কামু মুখোপাধ্যায় ১৯৩১ সালের ১৪ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *