বাবলু ভট্টাচার্য : প্রতিটি গ্রীষ্মই বাঙালিকে ঘুরে ফিরে কম-বেশি দার্শনিক করে তোলে। তার একটা বড় কারণ ২৫ বৈশাখ। আর একটি কারণ সত্যজিৎ-যাপন।
আসলে, চিন্তার স্ফুরণ, সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকা সামাজিক চেতনা, ভবিষ্যতের দিক-নির্ণয়, কালজয়ী কর্মজীবন এবং ক্ষণজন্মা প্রতিভার সমন্বয়ে গোটা উনিশ শতক ও বিংশ শতাব্দী জুড়ে বাংলার মননে যে বৈপ্লবিক আলোড়ন ঘটে গিয়েছিল, যাকে আমরা অনেকেই ‘বাংলার নবজাগরণ’ বলে থাকি, তার অভিমুখ রামমোহনে আরম্ভ হয়ে যদি রবীন্দ্রনাথে উৎকর্ষ লাভ করে, তা হলে সত্যজিৎ রায়ের বহুমুখী প্রতিভা সেই ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’র সম্ভবত শেষতম অধ্যায়।
সাঁইত্রিশ বছরের কর্মজীবনে পরিচালক হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের ৩৬টি ছবির (২৯টি পূর্ণদৈর্ঘ্য, পাঁচটি তথ্যচিত্র ও দু’টি স্বল্পদৈর্ঘ চিত্র) বিস্তৃতি ও গভীরতা নিঃসন্দেহে পৃথক এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণমূলক আলোচনার দাবি রাখে।
ছবির প্রয়োজনে হোক কিংবা স্বাধীন শিল্পী হিসেবে— অলঙ্করণ, কস্টিউম ও গ্রাফিক ডিজাইনিং, চিত্রনাট্য ও সাহিত্যরচনা, সম্পাদনা অথবা সুরসৃষ্টির মতো চারুকলার বিভিন্ন পরিসরে তাঁর অবাধ ও দক্ষ চলাচল— রায় পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর স্বতন্ত্র ও সফল পরিচিতি, জনমানসে তাঁর প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ব ও উপস্থিতি সত্যজিৎ রায়কে আজও সমান প্রাসঙ্গিক, সমান আধুনিক করে রেখেছে।
সত্যজিতের ছবির যে কোনও একটা দৃশ্য, একটা ছোটখাটো মুহূর্ত নিয়েই একটা গোটা নিবন্ধ লিখে ফেলা যায়, এমনটাই মনে করতেন ইংরেজ চলচ্চিত্র সমালোচক রবিন উড।
ছবি তৈরির একেবারে গোড়ার সময় থেকেই সত্যজিৎ তাঁর চিত্রনাট্যের উপাদান বেছে নিয়েছেন ধ্রুপদী বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার থেকে। পরবর্তীকালে যেখানে এসে মিশেছে সমকালীন সাহিত্য আর স্বরচিত লেখা।
উনিশ আর বিংশ শতকের ঔপনিবেশিক গ্রাম-বাংলা আর অনাগত শহর-সভ্যতার পটভূমিতে নির্মিত ‘অপু ট্রিলজি’, ‘পরশ পাথর’, ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’ বা ‘তিন কন্যা’র পরিচালক মূল টেক্সটের প্রতি অনুগত থেকেও সামাজিক পালাবদলের ‘ইমেজ’ নির্মাণে ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিকতার প্রতি সমান ভাবে দায়বদ্ধ থাকার চেষ্টা করেছেন।
আবার, ‘চারুলতা’র মতো কালনির্ভর ছবি বাদ দিলে ষাটের দশকের বেশির ভাগ ছবিতেই সত্যজিৎ কঠোর বাস্তববাদী ও সমসাময়িক। তবে, জীবনের অন্তর্নিহিত কল্যাণময়তার প্রতি তাঁর অগাধ আস্থা।
দার্জিলিঙের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সফল বাণিজ্য করতে না পারলেও সত্যজিৎ মনে করতেন, ছবিটি সময়ের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে— ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার কাঠামো ছিল একেবারেই চলচ্চিত্রের কাঠামো, যেটা আমার আগের কোনও ছবি সম্বন্ধেই বলা চলে না।’ অনেকের মতেই ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ বর্তমানের ‘হাইপারলিঙ্ক’ ছবি ঘরানার পূর্বসূরি।
সত্যজিৎ রায়ের শিল্পমাধ্যম আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় (শাখাপ্রশাখা), ব্যক্তি বনাম সমাজ (গণশত্রু), বর্ণভেদ ও জাতপাতের ভয়াবহতা (সদ্গতি), রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও ফ্যাসিবাদ (হীরক রাজার দেশে), উগ্র জাতীয়তাবাদ বনাম মানবতাবাদ (ঘরে বাইরে) এবং সভ্যতার সামগ্রিক সঙ্কটের (আগন্তুক) সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে, ভাবতে শিখিয়েছে।
তাই সত্যজিতের উপস্থিতি তাঁর প্রসঙ্গ ফুরায় না, কেবল এগিয়েই চলে।
সত্যজিৎ রায় ১৯২১ সালের আজকের দিনে (২ মে) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
নিজস্ব চিত্র এবং সংগৃহিত।
Be First to Comment