Press "Enter" to skip to content

সংগীত শিল্পী যূথিকা রায়ের এ বছর জন্মশতবর্ষ। যূথিকা রায়ের গানে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন…………

Spread the love

সংগীতা চৌধুরী : কলকাতা, ১৪, আগস্ট, ২০২০
১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ইউনিয়ন জ‍্যাক (ইংল্যান্ডের পতাকা) নামছে আর স্বাধীন ভারতের পতাকা উঠছে , এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি সে সময় আরও মধুর হয়ে উঠেছিল বাংলার এক কিংবদন্তী গায়িকা যূথিকা রায়ের সুরের স্পর্শে। আপামর ভারতবাসীর কাছে তিনি বাংলার মীরাবাঈ বলে খ‍্যাত। সরোজিনী নাইডু থেকে গান্ধীজি, জওহরলাল নেহরু, মোরারজি দেশাই , ইন্দিরা গান্ধী, মৌলানা আজাদ ,অন্নদা শঙ্কর রায় প্রমুখ বিশেষ ব‍্যক্তিবর্গ তাঁর গানের ভক্ত ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম স্বয়ং তারজন্য লেখেন ,’ ওরে নীল যমুনার জল’ গানখানি। এ হেন প্রথিতযশা শিল্পী যূথিকা রায়ের এ বছর জন্মশতবর্ষ , কাজেই এবছরের স্বাধীনতা দিবসের লগ্নে শিল্পীর স্মরণে তাঁর জীবনের বিশেষ অধ‍্যায়গুলি নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হল। ১৯২০ সালের ২০ এপ্রিল হাওড়ার আমতায় এই শিল্পীর জন্ম। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মেজ।যূথিকা রায়ের সঙ্গীত জগতে আসার পেছনে বাবা সত‍্যেন্দ্রনাথ রায়ের বড় অবদান ছিল। সত‍্যেন্দ্রনাথ একদিকে বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাজ করতেন এবং অন‍্যদিকে সঙ্গীতের প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ।বাবার কাছেই শিল্পীর সঙ্গীতের হাতে খড়ি।অত্যন্ত শিশু বয়সে অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং গ্রামোফোন কোম্পানিতে পৌঁছে গিয়েছিলেন বাবার হাত ধরেই। জীবিতকালে শিল্পী জানিয়েছিলেন যে,” বাবার খুব ইচ্ছে ছিল আমার গান গ্রামোফোনে রেকর্ড হোক। তখন আমার বয়স মাত্র সাত বছর। সেই বয়সেই আমাকে দিয়ে গান রেকর্ড করানোর জন্য বাবার জেদ চেপে গিয়েছিল। বাবার বদলির চাকরির কারনে আমার তিন- চার বছর বয়সেই আমাদের খুলনার সেনহাটি গ্রামে চলে আসতে হয়। খুলনাতেই একটি সঙ্গীত শিক্ষা কেন্দ্রে আমার গানের শিক্ষা শুরু হয়। ওখানে মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা দেওয়া হত। তখন ঋতুভিত্তিক গান গাওয়ার একটা চল ছিল। এছাড়া বাড়িতে বাবার কাছে শিখেছিলাম অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত আর ক্ল‍্যাসিকাল গান।কিন্তু সাত বছরে সরাসরি গ্রামোফোন কোম্পানিতে নিয়ে যাওয়াটা ছিল বাবার এক ধরনের খেয়াল।তবে অডিশন দিলেও, সেখানে গান রেকর্ড করা হয়ে ওঠেনি।ওখানকার কর্তাব্যক্তিরা আমার অল্প বয়সের কারন দেখিয়ে গান রেকর্ড করার প্রস্তাব নাকচ করে দেন। গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ফিরে এসেও বাবা কিন্তু মোটেই হতোদ্যম হলেন না। এরপর বাবা অল ইন্ডিয়া রেডিওতে নিয়ে যান অডিশন দিতে। এখানে কিন্তু প্রথম চেষ্টাতেই সফল হলাম। আমি যখন প্রথম অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গান গাই, সে সময়টায় কৃষ্ণচন্দ্র দে, ইন্দু বালা দেবী, আঙ্গুর বালা দেবী – অল ইন্ডিয়া রেডিও জুড়ে এঁদেরই রমরমা। রেডিওতে আমার প্রথম গান ছিল , “আর রেখো না আঁঁধারে আমায় দেখতে দাও”।.যূথিকা রায়ের মা স্নেহলতা দেবী ছিলেন এক ব‍্যতিক্রমী মহিলা। নিজের মেয়েদের স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি ,সেনহাটির অন‍্য মেয়েদের ও পড়াশোনার ব‍্যাপারেও দারুন উদ্যোগী ছিলেন। শুধু তাই নয়, যে সময় মায়েরা একটু বড় হলেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতেন, সে সময় দাঁড়িয়েই তিনি মেয়েদের ব্রক্ষ্মচর্য পালনের আদেশ দেন। মাত্র নয় বছর বয়স থেকেই শিল্পী আজীবন মায়ের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।আজীবন তিনি সাজসজ্জা বিহীন এবং সাদা শাড়িতেই দেশ- বিদেশে সমাদৃত হয়ে এসেছেন। তিনি জানিয়েছিলেন,” ব্রক্ষ্মচর্য জীবনের শুদ্ধতা তাঁর ভালো লাগে। বরং একমনে আজীবন তিনি সঙ্গীত সাধনায় ডুবে থাকতে পেরেছেন। সেই নয় বছর থেকে নিরামিষ আহার , সাজসজ্জা হীন থাকা ও আরো কিছু নিয়মাবলী ভালোবেসেই পালন করেছেন।” যূথিকা রায় অনেকের কাছেই সঙ্গীতের শিক্ষা নেন,কিন্তু গুরু হিসেবে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ করেন। তিনি ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের গানের একান্ত ভক্ত ছিলেন। তবে শিল্পীর জীবনে কমল দাশগুপ্তের ও অনেক প্রভাব আছে। ওঁর সুরে বহু ভজন গেয়েছেন। তাই বর্ষীয়সী শিল্পী বলেছিলেন যে,” আমি কমল দাশগুপ্তের কাছে ঋনী। “১৯৩৪ সালে চোদ্দো বছর বয়সে কমল দাশগুপ্তের সুরে ও প্রনব রায়ের কথায় গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে শিল্পীর দুটি গান রেকর্ড করা হয় ,- ভৈরবীতে ‘আমি ভোরের যূথিকা ‘আর ইমনকল‍্যানে ‘ সাঁঝের তারকা আমি ‘। প্রথমে রেকর্ড দুটি কোম্পানির বোর্ডের ডিলাররা নিতে চান নি , কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের হস্তক্ষেপে সেই রেকর্ড প্রকাশ পায়। নজরুল ইসলাম তখন সেখানকার একটি বিশেষ পদে ছিলেন । রেকর্ড গুলি প্রকাশের তিন মাসের মধ্যে ৬০,০০০ কপি বিক্রি হয়ে যায়। কিশোরী শিল্পী হিসেবে যূথিকা রায় প্রতিষ্ঠা পেলেন। এইচ.এম.ভি – থেকে তাঁর ৩০০ গানের রেকর্ড বেরিয়েছে , তবে ৬০ বছরের পর আর রেকর্ড করেন নি গলার কারনে। শুধু এখানেই নয়, সারা দেশেই শিল্পীর গানের কদর ছিল। এক সময় মুম্বাইতে বহু কাল কাটিয়েছেন। সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়িয়েছেন গানের জন্য। ৫৫ সালে তিন মাসের জন্য ইস্ট আফ্রিকা গিয়েছিলেন।

তিনটি হিন্দী ছবিতে তিনি নেপথ্য কন্ঠ শিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন, সেগুলো ছিল – সুচিত্রা সেনের লিপে ‘ ঢুলি ‘ ছবিতে ‘ এই যমুনারি তীরে ‘ , ‘ রতনদীপ ‘ ছবিতে ‘ ম‍্যায় তো রামও রতনও ধন পায়ো ‘ , ‘ প্রীত কি এ দুখো হই ‘ এবং ‘লালাকার ‘ ছবিতে। এরপর আর ও বহু সিনেমার অফার এসেছিল কিন্তু শিল্পী রাজী হননি। যূথিকা রায়ের ধারনা ছিল , ” সিনেমার গান গাইলে ভজনের ভাব নষ্ট হয়ে যায়।”একদম শুরুর দিকে শিল্পীর ‘ আমি ভোরের যূথিকা ‘ রেকর্ডটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শোনানো হয়েছিল গ্রামোফোন কোম্পানির উদ‍্যোগে, কবি সেই গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তবে সেদিন কাজী নজরুল ইসলাম তার রেকর্ড বার করার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা না করলে হয়তো তাঁর আর এভাবে গান গাওয়াই হত না ,এ কথা তিনি বার বার উল্লেখ করতেন। পরবর্তীকালে নজরুলের সুরে তিনি বহু গান গেয়েছেন।

১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে গান গাওয়ার স্মৃতিতে আজীবন তিনি গর্ব অনুভব করেছেন। সেই স্মৃতি চারনা করে শিল্পী বলেছিলেন,
” আমি তখন দিল্লিতে ছিলাম, হঠাৎ আমার কাছে খবর এল পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর ইচ্ছে যে ,লাল কেল্লার সামনে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় আমি যেন গান গাই । আমার সে কি ভয় ! আমি একদম ভোরে পোঁছে যাই বেতার কেন্দ্রে।তারপর নির্দিষ্ট সময় দিল্লির বেতারে সম্প্রচারিত হয় আমার ‘ সোনেকা হিন্দুস্থান মেরা ‘ গানটি আর তার সঙ্গেই তাল মিলিয়ে পতাকা ওঠে। ” ইন্দিরা গান্ধী এই শিল্পীর গানের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ও বিভিন্ন কঠিন সময় শিল্পীর গান শুনে শান্তি পেতেন। আরও বহু বিদগ্ধ ব‍্যক্তি ওঁর গুনমুগ্ধ ছিলেন । ১৯৭২ সালে এই প্রথিতযশা শিল্পী ‘পদ্মশ্রী ‘ সন্মানে ভূষিত হন।

৮০ সালের পর তিনি ক্লান্ত হয়ে গিয়ে কলকাতাতেই থিতু হন। তাই বাড়িতেই গানের ক্লাস শুরু করেন। যত দিন বেঁচে ছিলেন অক্লান্ত ভাবে শিক্ষা দানের কাজ করে গেছেন।শেষ দিকে নিজের সুরে কয়েকটি গানের রেকর্ড করেছিলেন।নব্বই পেরিয়ে ও অসীম জীবনীশক্তি ছিল তাঁর।নিজে নিয়মিত লেখালেখি ও করতেন।’ আজও মনে পড়ে ‘ বইটি পুরোটাই তিনি নিজে লিখেছিলেন। আজ ছ’বছর হল তিনি চলে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর এই জন্মশতবর্ষের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে বর্তমান এই কঠিন সময়ের জন্য তাঁর মতো সুরসাধিকা শিল্পীদের বড়ই প্রয়োজন ,যাঁদের সঙ্গীত এই জগতে শান্তির বাতাবরন আনবে।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.