Press "Enter" to skip to content

শ্রদ্ধাঞ্জলি- এই জাকির, এ হলো রাজিকা…পরিমলদা র ছাত্রী..খুব ভালো নাচে।”শুনে উনি পরিষ্কার বাংলায় বললেন, “ভারী মিষ্টি মেয়ে…তাহলে তো তোমার সঙ্গে বাজাতে হয়।”….।

Spread the love

আত্মকথায় রাজিকা মজুমদার : সম্পাদক নবকল্লোল, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪। জাকির হুসেইন – নামটির সঙ্গে কে না পরিচিত। আমার ওনাকে প্রথম দেখা চলচিত্রের পর্দায়। আশির দশক …আমি তখন অনেক ছোটো। রাতে টিভি তে অ্যাডাল্ট সিনেমা দেখাত প্রতি শুক্রবার । একদিন রাতে হঠাৎ করেই দেখলাম তাঁকে ‘Heat and Dust’ নামক ছবিতে। পুরো ছবিটা অবশ্য দেখতে পাইনি কারণ, কিছুই বুঝছিলাম না আর ঘুমও বেজায় পাচ্ছিলো। তার ওপর বকুনির ভয় তো আছেই।
ছোটবেলা থেকে কত্থক নাচ শিখেছি। মা চার বছর বয়েস বাণীচক্র এ ভর্তি করে দিয়েছিলো। জেঠু সেতার বাজাতেন তাই ওনার কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের অনেক ওস্তাদের নাম শুনেছি। জাকির হুসেইন নামটা জেঠুর মুখেই শোনা। শুনেছিলাম তিনি নাকি দারুণ তবলা বাজান এবং দেখতেও নাকি রাজপুত্রের মত। ‘ Heat and Dust’ এ যখন দেখলাম ওনাকে তখন কিন্তু আমার মোটেও ওনাকে রাজপুত্র লাগেনি। এরপর কয়েক বছর কাটলো, আসতে আসতে আমিও আরেকটু বড় হলাম। তখন ওনাকে দেখলাম টিভি তে চায়ের বিজ্ঞাপন এ….তবলা বাজিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে চা এর কাপ এ চুমুক দিয়ে বলছেন ” আরে হুজুর…waah তাজ বোলিয়ে।” সেই সময় বোধ বুদ্ধি সামান্য হলেও বেড়েছে…তাই নতুন রূপে স্বপ্নালু চোখে ওনাকে দেখে বেশ রোমাঞ্চ হতো । এরপর আরেকটু বড় হলাম..আরেকটু বুঝতে শিখলাম। নাচ যথারীতি চলছে। আমার গুরুজী, শ্রী পরিমল কৃষ্ণ দে তখন আমায় তৈরি করছেন ডোভারলেন মিউজিক কনফারেন্সে এ পারফর্ম করার জন্য। প্রত্যেক বছরই গুরুজীর অন্যতম সেরা ছাত্রীরা ওখানে নৃত্য পরিবেশন করার সুযোগ পেত । কিন্তু আমি তৈরি থাকলেও ওখানে নৃত্য প্রদর্শন করার যে বয়েস থাকা দরকার তা তখনও আমার হয়নি। যাইহোক, আমার নাচের সময়ে তবলায় সঙ্গত করতেন শ্রী রঘুনাথ ভট্টাচার্য। আমরা রঘুদা বলেই সম্বোধন করতাম এবং ওনার সঙ্গে বিস্তর গল্প ঠাট্টা ইয়ার্কি ও মারতাম। রঘুদা ভালো তবলা বাজাতেন , বিস্তর প্রোগ্রাম ও করতেন। অনেক নামী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীদের সঙ্গে বাজিয়েছেন , বিদেশ গেছেন পারভীন সুলতানা জি র সঙ্গে পারফর্ম করতে। সেই রঘুদার সঙ্গে আলাপ ছিল জাকির হুসেনের আর রঘুদা বলতেন “এবার জাকির কলকাতায় এলে তোকে নিয়ে যাব আলাপ করাতে। ”
সেবার শীতকালে যখন ডোভারলেন  মিউজিক কনফারেন্স  হলো, আমি আর আমার মা গেলাম প্রোগ্রাম দেখতে- জাকির হুসেইন আর বিলায়েত খান সাহেবের যুগলবন্দি। রঘুদাও ছিলেন সঙ্গে। প্রোগ্রাম শুরু হলো ।আমরা প্রথম সারিতেই বসেছিলাম, মঞ্চের কাছাকাছি …ভীষণ এক্সসাইটেড ।এত কাছ থেকে এত বড় শিল্পীদের দেখতে পাবো, তাঁদের পারফরমেন্স চাক্ষুষ দেখব, শুনব এ তো আমার স্বপ্নের অতীত।
বাজনা তখন জমে উঠেছে…জাকির হুসেইন তাঁর সিগনেচার  স্টাইল এ মাথা ঝাঁকিয়ে হল কাঁপাচ্ছেন, প্রচুর হাততালি পড়ছে..এবং…..তারই মাঝে কিছুক্ষণ পর পরই স্টেজ থেকে আমাদের দিকে দেখছেন….কারন রঘুদা সিট থেকে ওনাকে হাত নেড়েছেন।
প্রায় ঘন্টা খানেক বাজানোর পর বিলায়েত খান সাহেব বিরতি নিলেন। আর ঠিক তখন ই রঘুদা আমায় হ্যাঁচকা টান মেরে গ্রীন রুম এর দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললেন “শিগগির চ…এই সময় ফাঁকা থাকবে…নয়তো এরপর মিডিয়া ঢুকে পড়লে আমরা আর চান্স পাবো না।” আমি দুরু দুরু বুকে রঘুদার পিছন পিছন দৌড়াতে শুরু করলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে গ্রীন রুম এ পৌঁছে দেখি বিলায়েত খান জি কারো সাথে কথা বলছেন…আর জাকির সাহেব বসে ফ্লাস্ক থেকে ঢাকনা তে চা ঢেলে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। আমরা ঢুকতেই রঘুদা কে দেখে উনি ” আরে কি ব্যাপার রঘু ..কেমন আছো ” বলে একটা খুশী হওয়া হাসি হাসলেন। এবার রঘুদা আমায় কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে ইশারা করতেই আমি ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। উনি হেসে রঘুদার দিকে জিজ্ঞাসা ভরা চোখে তাকাতেই রঘুদা বললেন….”এই জাকির, এ হলো রাজিকা …পরিমলদা র ছাত্রী….খুব ভালো নাচে।” শুনে উনি পরিষ্কার বাংলায় বললেন , ” ভারী মিষ্টি মেয়ে…তাহলে তো তোমার সঙ্গে বাজাতে হয়।” শুনে তো আমি থ। এত বড় শিল্পী আমার সঙ্গে সঙ্গত করতে চাইছেন!!! আমি বলার মত কিছুই আর পেলাম না… হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। ইতিমধ্যে বিলায়েত জি তাঁর কথা এবং চা পর্ব শেষ করেছেন। এবার উস্তাদ জাকির হুসেইন বিলায়েত খান জির সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন..যেন আমি কত দিনের চেনা। আমি ওনাকেও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। উনি মাথায় হাত দিয়ে শুধু বললেন ” বাহ,” তারপর মঞ্চে ফেরার জন্যে উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে জাকির হুসেইন জি ও ঢক্ করে বাকি চা টা গিলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মঞ্চের দিকে পা বাড়ানোর ঠিক আগে আমার চিবুক ধরে নাড়িয়ে হেসে বললেন, ” চলি, আবার দেখা হবে। ” আমার ক্ষুদ্র জীবনে যেন ইতিহাস ঘটে গেলো। সেই মুহূর্তের উত্তেজনা, আনন্দ, স্বীকৃতি আমায় এতটাই প্রভাবিত করেছিলো যে বেশ কয়েকদিন আমার কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে এই এক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনে শুনে আমার বাড়ির লোকজন আমার ওপর শেষে বিরক্ত হয়ে গেলো। অনেকদিন এই ঘটনা র চর্চা হতো বিভিন্ন আত্মীয়ের কাছে। তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেলো। নাচ থেকে পড়াশোনার গুরুত্ব বাড়লো। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বাইরে গেলাম, ধীরে ধীরে নাচ বা ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের জগৎ থেকে দূরে সরে গেলাম । কলেজ এ পড়া কালীন গান গেয়ে পপুলার হয়েছিলাম ছাত্র মহলে । তবে আসতে আসতে এইসব ঘটনা গুলোর প্রাধান্য বা গুরুত্ব ম্লান হয়ে এলো। আমি তখন সবে সবে সাবলম্বী হচ্ছি …জীবনের ভাবনা গুলো নানা আকার নিচ্ছে। ছোটবেলার ছোট্ট মনে দাগ কাটা ঘটনাটা কখন নতুন ভাবনার স্তুপে চাপা পড়ে গেছে।
আজ উস্তাদ জাকির হুসেনের প্রয়াণ সংবাদ পেতেই ছোটবেলার সেই স্মৃতি গায়ের ধুলো ঝেড়ে নাড়াচাড়া দিয়ে জেগে উঠল। চোখের সামনে সিনেমার মতো পুনরায় ঘটে গেলো সেই ঘটনা গুলি।এই স্মৃতি আমার কাছে অমূল্য। সঙ্গীত জগতের সেরা শিল্পী, একই সঙ্গে অমায়িক , আমুদে , প্রতিভাশালী এবং বহুগুণাধিকারী, সেই নক্ষত্র আজ খসে পড়ল। আমার সামান্য কলমে এই স্মৃতিচারণার মাধ্যমে শিল্পীর প্রতি এটাই আমার শ্রদ্ধা নিবেদন।
(ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া ওনার সঙ্গে আমার কোনো ছবি নেই)

More from EntertainmentMore posts in Entertainment »
More from InternationalMore posts in International »
More from MusicMore posts in Music »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.