অশোক দে : ৯ মার্চ, ২০২১। তখন আধুনিক বাংলা গানে রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন শচীন দেববর্মণ, সুধীরলাল চক্রবর্তী, তালাত মাহমুদ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যরা। স্বাভাবিকভাবে দুজন তরুণ সেখানে থৈ পাবেন না। কর্তৃপক্ষের রায় পান্নালাল ভট্টাচার্য-র কন্ঠ নেগেটিভ! এই সময় একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন অগ্রজ ধনঞ্জয়। বললেন সনৎ গাইবে ছোটদের গান আর পান্না শ্যামাসঙ্গীত। এর পেছনে হয়তো একটা কারণ হতে পারে দুজনের কন্ঠস্বর প্রায় একই ধাঁচের। কালক্রমে ধনঞ্জয় হলেন কলম্বিয়ার শিল্পী আর পান্না হিজ মাস্টার ভয়েজ-এর। ১৯৫২-তে বের হওয়া রামপ্রসাদী ‘আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে’ বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছিল।

এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি! ‘আমার সাধ না মিটিল’- প্রচলিত সুরকে নিজের মতো করে রেকর্ড করেন এবং দিনে দিনে ভক্তিগীতির আইকন হয়ে ওঠেন। উল্লেখ্য তালিকায় রয়েছে : সকলই তোমার ইচ্ছা, শ্যামা মা কী আমার, দোষ কারো নয় গো মা ইত্যাদি ইত্যাদি। আশ্চর্য যে গানটি গেয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিলেন সেই ‘সাধ না মিটিল’-র রয়ালটি তিনি পাননি অদ্ভুত নিয়মে। আবার অন্যদিকে একটা অপপ্রচার আছে পান্না হতে চেয়েছিলেন আধুনিক গানের শিল্পী। অন্তরায় হন তাঁর ফ্রেন্ড, ফিলোজফার ও গাইড দাদা ধনঞ্জয়। এটা একেবারেই মিথ্যে। জহুরি ধনঞ্জয় ঠিকই চিনেছিলেন যে শ্যামাসঙ্গীতই তাঁর আসল ক্ষেত্র। নিজের চেষ্টায় এবং ঘিরে থাকা পারিষদমন্ডলীর প্ররোচনায় লঘু সঙ্গীতের দশ-বারো খানা রেকর্ড করেছিলেন। দু-একটি ছাড়া শ্রোতারা সেভাবে গ্রহণ করেননি। ভুল বুঝে অচিরেই ফিরে আসেন নিজের আসনে।

ধনঞ্জয়বাবু ভক্তিগীতি রেকর্ড করার অনেক অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র ভাইয়ের কথা ভেবে। ছায়াছবির নেপথ্যে গাইলেও বেসিক গান, নৈব নৈব চ। এমনকি পান্না-র মৃত্যুর পরে বহুদিন ভক্তিগীতি গাইতেন না। এই সেদিন ৫ মার্চ, নিঃশব্দে পেরিয়ে এলেন তাঁর বিরানব্বইতম জন্মদিন। আসলে সৃষ্টি বোধ হয় স্রষ্টাকে ছাপিয়ে যায়! ভক্তিগীতির এই অনন্য শিল্পী জন্মেছিলেন বালির বারেন্দ্র পাড়ায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তিনি অকালে চলে যান ‘১৯৬৬-এর ২৭ মার্চে। সেই হিসেবে মৃত্যুর অর্ধ শতবর্ষ অতিক্রম করলেন শ্যামাসঙ্গীত ও কাব্যগীতির এই অসামান্য রূপকার। তাঁর আবির্ভাব এমন একটা সময়ে, যখন বাংলা গানের খ্যাতনামা ভবানী দাস, মৃণালকান্তি ঘোষ, কে মল্লিক, কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মতো গায়করা উজ্জ্বল। তবুও একটা শূন্যতাও যেন গ্রাস করছিল, এরপর কী ! পান্না এলেন আধুনিক বাংলা গানের শিল্পী ধনঞ্জয়ের সহচর্যে। তাঁর সম্পর্কে প্রত্যক্ষ স্মৃতি উসকে দিলেন ধনঞ্জয় পুত্র গায়ক দীপঙ্কর। জানালেন সাংগীতিক পান্না সম্পর্কিত তথ্য। কাকা পান্না যখন সাত মাসের মাতৃগর্ভে তখন পিতা সুরেন্দ্রনাথ মারা যান। ফলে মা অন্নপূর্ণা দেবীর বিষ নজরে এই নবজাতক। এই সংস্কারবদ্ধতা থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন মাতৃপ্রতিম বৌদি রেখা দেবী। ছোট থেকেই গান-বাজনা টানতো তাঁকে।বড় দুই দাদা প্রফুল্ল ও ধনঞ্জয় তো গানের জগতেরই। পান্না অবিকল নকল করে গাইতে পারতেন মেজদা ধনঞ্জয়ের ফিল্ম ও রেকর্ডের গান। স্বভাবতই তাঁর প্রথম গুরু মেজদাই। এছাড়া গান শিখেছেন প্রতিবেশী সনৎ সিংহের দাদা কিশোরীমোহনের কাছে। দাদা সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্য সনৎ ও পান্নাকে নিয়ে যান মেগাফোন রেকর্ডিং কোম্পানিতে। অডিশনে দুজনেই উত্তীর্ণ হন। ৪০-এর শেষের দিকে রেকর্ডি়ংও হয় তাদের। প্রফুল্লবাবু সেই সময় নানা জলসায় নিয়ে যেতেন গান করাতে। পান্নালাল আড্ডার পাশাপাশি মাছধরা, ফুটবল খেলতেও ভালোবাসতেন। এই ফুটবল খেলতে গিয়েই একটা প্রাণঘাতী দুর্ঘটনায় পড়েন। চোখ দুটো প্রায় যেতে বসেছিল। মেডিক্যাল কলেজে অনেক চিকিৎসার পর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেও চোখের মণি দুটি ঈষৎ ট্যারা হয়ে যায়। তাঁর শেষ রেকর্ড ধনঞ্জয়ের সুরে ‘অপার সংসার নাহি পারাবার।’ ‘আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানি না’ ও ‘আমি সব ছেড়ে ধরবো তোমার’-এর মতো গানের রচয়িতা রজনীকান্ত-র দৌহিত্র দিলীপ কুমার রায় জানালেন পান্না ছিলেন লাজুক স্বভাবের– একটু সরে সরে থাকতেন। ও গানকে বৃত্তি করলেও স্বাভাবিক সৌজন্যের কোনো অভাব ছিল না। কথা বলতেন যথেষ্ট সম্ভ্রমের সঙ্গে। দিলীপবাবু আরও জানান ‘৬৫-তে রজনীকান্ত-র শতবর্ষ উপলক্ষে তাঁরই তালিমে পান্না রেকর্ড করেন ‘তুমি নির্মল কর”, ‘আমি সকল কাজে পাই সে সময়’, ‘কবে তৃষিত এ মরু, ‘সকল রকমে কাঙাল করিয়া’, ‘আমি অকৃতি অধম’ ইত্যাদি। শেষেরটিতে তার গায়কিতে অকৃত্রিম ভালোবাসা ও মহত্ব প্রকাশ পায়। মহাজাতি সদনে একবার ‘পাবনা সম্মিলনী’ অনুষ্ঠানে তার নাম শিল্পী তালিকায় ছিল।

সে সময় তরুণ স্বেচ্ছাসেবী দিলীপ কুমারের ওপর ভার ছিল তাঁকে নিয়ে আসার। ঘটনাচক্রে হয়ে ওঠেনি। পান্না কিন্তু নিজেই বৃষ্টির মধ্যে হাজির হন, একথা বলতে গিয়ে আবেগরুদ্ধ হয়ে পড়েন প্রবীণ দিলীপ বাবু। ‘কেন বঞ্চিত হব চরণে’ রেকর্ড করতে চাইতেন খুব। আফশোস, হয়ে ওঠেনি। পুরাতনী গানের অন্যতম প্রতিনিধি চন্ডীদাস মাল পান্নাবাবুর আবেদন ও গায়নভঙ্গিতে অভিভূত যা সাধারণ শ্রোতাকে আবিষ্ট করে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বরিষ্ঠ শিল্পী হয়েও রাগপ্রধান বাংলা গানেও অজয় চক্রবর্তী সচ্ছন্দ। তিনি ইদানীং রামপ্রসাদীও গেয়েছেন। প্রতিক্রিয়া দিলেন, পান্নাবাবু এক কথায় অপূর্ব। মানুষ যেমন মহালয়া বলতেই বোঝেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তেমনি শ্যামাপুজো বা শ্যামা মায়ের নাম বলতেই বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্যের নাম সবার প্রথমে মনে পড়ে।


Be First to Comment