স্মরণঃ সঞ্জীব কুমার
বাবলু ভট্টাচার্য : মাত্র ৪৭ বছরের আয়ু নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। কিন্তু এই অভিনেতা বেশিরভাগই সময়ই অভিনয় করেছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তির চরিত্রে। তিনি সঞ্জীব কুমার, হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অভিনেতা। ‘শোলে’, ‘ত্রিশূল’, ‘বিধাতা’, ‘আঁধি’, ‘সিলসিলা’, ‘কোশিশ’, ‘নায়া দিন নায়ি রাত’, ‘দাস্তাক’, ‘অনামিকা’র মতো ছবিতে সঞ্জীব কুমারের অভিনয় হিন্দি সিনেমাপ্রেমীদের অনেক দিন মনে থাকবে। ‘শোলে’ সিনেমার ঠাকুর বলদেব সিং হিন্দি সিনেমার আইকনিক চরিত্রগুলোর একটি। ‘কোশিশ’ সিনেমায় সঞ্জীব কুমার এক মূক-বধির ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করেন। তার বিপরীতে মূক-বধির নারীর ভূমিকায় ছিলেন জয়া ভাদুড়ী (বচ্চন)। বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন সংগ্রাম, আবেগ-অনুভূতি, আনন্দ-বেদনা পর্দায় সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলেন সঞ্জীব। ‘নয়া দিন নায়ি রাত’ ছবিতে নয়টি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক সমালোচকদের বিপুল প্রশংসা পান সঞ্জীব কুমার। নায়ক হিসেবে সার্থক হলেও তার মূল আকর্ষণ ছিল বিচিত্র সব চরিত্রে অভিনয় করার প্রতি। আর তাই তাকে হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে সার্থক চরিত্রাভিনেতা বললে ভুল বলা হবে না।

সঞ্জীব কুমারের আসল নাম হরিহর জেথালাল জরিওয়ালা। মুম্বাই সিনেপাড়ার ঘনিষ্টজনেরা তাকে ‘হরিভাই’ বলে ডাকতেন। জন্ম ১৯৩৮ সালের ৯ জুলাই এক গুজরাতি পরিবারে। পরিবারের সঙ্গে শৈশবের বেশ কয়েক বছর কাটে সুরাটে। পরবর্তীতে মুম্বাইয়ে স্থায়ী হয় তাদের পরিবার। চলচ্চিত্রে সঞ্জীব কুমারের অভিষেক ঘটে ১৯৬০ সালে ‘হাম হিন্দুস্তানি’ ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৫ সালে ‘নিশান’ ছবিতে তিনি প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি দিলীপ কুমারের সঙ্গে ‘সংঘর্ষ’ ছবিতে অভিনয় করে খ্যাতি পান। ১৯৬৯ সালে ‘শিকার’ ছবিতে পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার ফিল্মফেয়ার জিতে নেন। ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘খিলোনা’ ছবিতে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির ভূমিকায় তার অভিনয়ও সাড়া ফেলেছিল। ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় সুপার হিট ছবি ‘সীতা অউর গীতা’। এতে হেমা মালিনির বিপরীতে অন্যতম নায়ক ছিলেন সঞ্জীব। এ ছবির সুবাদে সফল তারকা হিসেবে বক্স-অফিসেও স্বীকৃতি পান। রোমান্টিক নায়ক হিসেবে নির্মাতাদের কাছে তার চাহিদা সৃষ্টি হয়। ১৯৭৩ সালে রোমান্টিক থ্রিলার ‘অনামিকা’ তাকে বেশ জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ছবিতে তার বিপরীতে নায়িকা ছিলেন জয়া ভাদুড়ী। ১৯৭৩ এ মুক্তি পাওয়া ‘মাঞ্চালি’ ছবিটিও ব্যবসা সফল হয়। তবে সঞ্জীব পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনয় করতেই বেশি ভালোবাসতেন। সে কারণেই রাজেশ খান্না-মুমতাজ জুটির ‘আপকি কসম’ ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেন এবং খ্যাতি পান সু-অভিনয়ের জন্য। বলিউডের নামকরা পরিচালক গুলজার সঞ্জীবের অভিনয় প্রতিভার কদর করতেন। তিনি ‘কোশিশ’ ছবিতে সঞ্জীবকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। দুজন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবন ও সম্পর্ক নিয়ে সিনেমাটিতে সঞ্জীবকে তরুণ ও বৃদ্ধ দুই বয়সেই দেখানো হয়। ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটিতে অভিনয়ের জন্য ফিল্মফেয়ার আসরে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পান এবং জিতে নেন বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড।

সে বছর সেরা অভিনেতার ফিল্মফেয়ার না পেলেও ১৯৭৬ সালে ‘আঁধি’ (১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত) ছবিতে অভিনয়ের জন্য সে পুরস্কার অর্জন করে নেন। গুলজার পরিচালিত ‘আঁধি’ সিনেমায় এক রাজনৈতিক নেত্রীর অখ্যাত স্বামীর ভূমিকায় সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন সঞ্জীব। গুলজারের পরিচালনায় মোট নয়টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। তার অভিনীত ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মওসাম’ ছবিটিও ব্যবসাসফল এবং এর জন্য সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। তবে ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘শোলে’তে ঠাকুর চরিত্রটি তার নাম হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে দিয়েছে। সেসময় তার বয়স ছিল ৩৭ বছর। অথচ তিনি মধ্যবয়সী ঠাকুরের ভূমিকায় ছিলেন সম্পূর্ণ মানানসই। ‘ডমরু’ ছবিতে তিনি ছয় সন্তানের জনক ষাট বছর বয়সী এক বৃদ্ধের চরিত্রে অভিনয় করেন। ‘ত্রিশূল’ ছবিতেও মধ্যবয়সী ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করেন যুবক সঞ্জীব। ১৯৭৭ সালে ফিল্মফেয়ার আসরে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান ‘অর্জুন পণ্ডিত’ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের সুবাদে। কেবল গম্ভীর চরিত্রে নয় কমেডিতেও ছিলেন অসামান্য। শেক্সপিয়রের নাটক ‘কমেডি অব এররস’ অবলম্বনে নির্মিত ‘আঙ্গুর’ ছবিতে দ্বৈত চরিত্রে তার অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। এ ছবিও তাকে ফিল্মফেয়ারে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন এনে দেয়। ‘দেবতা’, ‘নামকিন’, ‘ইয়ে হ্যায় জিন্দেগি’, ‘পতি পত্নী অউর ও’ – এমন অনেক ছবিতে স্মরণীয় অভিনয় করেছেন তিনি। তিনি দুবার সেরা অভিনেতা এবং একবার পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার ফিল্মফেয়ার পেয়েছেন আর ১১বার সেরা অভিনেতা এবং তিনবার পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন।

২৫ বছরের ক্যারিয়ারে গুজরাটি, মারাঠি, পাঞ্জাবিসহ ভারতের বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক ভাষার ছবিতে অভিনয় করেছেন।
সঞ্জীব কুমার হৃদপিণ্ডে ত্রুটি নিয়ে জন্মেছিলেন। তার পরিবারের অনেক সদস্যই ৫০ বছরের আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রথমবার হার্ট অ্যাটাকের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাইপাস অপারেশন করান।
সঞ্জীব কুমার ১৯৮৫ সালের আজকের দিনে (৬ নভেম্বর) ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুর পর তার অভিনীত গোটা দশেক ছবি মুক্তি পায়। তার অভিনীত সর্বশেষ ছবি ‘প্রফেসর কি পাড়োসান’ মুক্তি পায় ১৯৯৩ সালে।

Be First to Comment