স্মরণঃ উ ত্ত ম কু মা র
বাবলু ভট্টাচার্য : তাঁর ভুবন ভোলানো হাসি, অকৃত্রিম রোমান্টিক চোখের দৃষ্টি আর অতুলনীয় অভিনয়ের গুণে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়েও বাঙালি দর্শকদের হৃদয়ের মণিকোঠায় তিনি মহানায়ক। ১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ দিয়ে শুরু আর ১৯৮০ সালে এসে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবিতে অভিনয় করার সময় জীবনাবসান।
মাত্র ৫৪ বছরের ক্ষণজন্মা কিংবদন্তী অভিনেতা মহানায়ক উত্তমকুমার চলচ্চিত্র শিল্পকে দিয়েছেন পাক্কা ৩২টি বছর। তবুও তৃপ্তি মেটে না। তিন তিনবার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার- প্রাপ্ত এই অভিনেতা সম্পর্কে যতই বলা হোক না কেন তা কম হবে।
১৯৩৯ সাল। দেশজুড়ে তখন এক অশান্ত অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা। সেই উত্তপ্ত সময়ের মধ্যে কৈশোর পেরিয়ে যৌবন উত্তমের। ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন কলকাতার সাউথ সুবার্বান মেইন স্কুল থেকে। ভর্তি হন কলকাতার গোয়েনকা কমার্স কলেজে। এখানে পড়েন কমার্স নিয়ে।
কলকাতার ভবানীপুর এলাকায় থাকতেন উত্তম কুমার। কাছাকাছি পাড়ায় সেকালের রূপবান নায়ক ধীরাজ ভট্টাচার্য, পুরনো ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, চরিত্রাভিনেতা ইন্দু মুখার্জি বসবাস করতেন। তাঁদের কাজ দেখে শিখেছেন উত্তমকুমার।
অভিনয়ের চেয়েও তখন তাঁর বড় মূলধন ছিল চেহারা। অথচ উত্তম কুমার প্রথম দিকের কোনো ছবিতেই নায়কের ভূমিকা পাননি। শুধু মুখ দেখানো ছাড়া আর কোনো অস্তিত্বই ছিল না সেখানে।
মায়াডোর, দৃষ্টিদান, কামনা, মর্যাদা, ওরে যাত্রী, নষ্ট নীড়, সঞ্জীবনী প্রভৃতি ছবিতে উত্তম কুমার ছিলেন। এর মধ্যে একটি ছবিও ব্যবসাসফল হয়নি। যে জন্য উত্তম কুমার তখন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন।
তাঁর ভাগ্য খুলে দেয় ‘বসু পরিবার’ ছবিটি। ছবিটি ব্যবসাসফল হওয়ার পাশাপাশি দর্শক- সমালোচক মুখরিত হয় তাঁর প্রশংসায়। প্রচুর কাজের প্রস্তাব পেতে থাকেন তিনি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর অভিনেতা বনে যান তিনি।
১৯৫৪ সালে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবি দিয়েই উত্তম কুমারের জয়যাত্রা শুরু। নায়িকা সুচিত্রা সেন। প্রায় ম্যাজিকের মতো ফল পাওয়া গেল ‘অগ্নিপরীক্ষা’ থেকে। বাংলা ছবিতে যে ভাটার টান অনুভব করা যাচ্ছিল, সেই স্তিমিত জলে সহসা আবেগ সঞ্চার করল ‘উত্তম-সুচিত্রা’ জুটি। বাংলা ছবিতে এলো গ্ল্যামার, দর্শকদের ভালো লাগার সঙ্গে যুক্ত হলো মুগ্ধতা। নায়ক থেকে মহানায়কের শীর্ষ আসনটিতে উত্তরণের সঠিক যাত্রারম্ভ হলো এই ‘অগ্নিপরীক্ষা’ থেকে।
চলচ্চিত্রের নায়ক উত্তম কুমার পর্দার বাইরেও কিংবদন্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন আপামর জনসাধারণের মধ্যে। সাধারণ মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাছে সুদর্শন পুরুষ অথবা রোমান্টিকতার সার্থক উদাহরণ ছিলেন উত্তম কুমার। নায়ক শব্দের আগে ‘মহা’ শব্দটি যোগ হয়েছিল ১৯৭০ সালের পর থেকে। এটা কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না।
অভিনয় পাগল উত্তম কুমার চলচ্চিত্রের সংগে সংগে সমান তালে মঞ্চেও কাজ করে গেছেন। স্টার থিয়েটারে এক নাগাড়ে ‘শ্যামলী’ নাটকের ৪৮৬টি প্রদর্শনীতে তিনি অভিনয় করেন।
১৯৫৬ সালে উত্তম কুমার অভিনেতা থেকে প্রযোজক হয়ে ‘হারানো সুর’ চলচ্চিত্রটি উপহার দেন। রাষ্ট্রপতি ‘সার্টিফিকেট অব মেরিট’ সম্মান পায় ছবিটি। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র তিনি পরিচালনাও করেছেন।
বাংলা সিনেমার আরেক কিংবদন্তী সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ও ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্যও তিনি জাতীয় পুরস্কার পান।
উত্তমকুমার ১৯৮০ সালের আজকের দিনে (২৪ জুলাই) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment