নিজস্ব প্রতিনিধি : কলকাতা, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫। শারদীয়া মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব। ভাদ্রের আকাশ মেঘমুক্ত হতে না হতেই, কাশফুল দুলতে শুরু করলে, শিউলির গন্ধে ভরে উঠলে সকালবেলা বাঙালির মনে বাজতে শুরু করে ধুনুচি নাচের ঢাকের তালে সেই অদ্ভুত এক সুর। দুর্গাপুজো যেন বাঙালির এক চিরন্তন চেতনা, যা কেবল ধর্মীয় নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আবেগের উৎসব।
মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ বাঙালির অন্তরে যে সুর তোলে, তা-ই আসলে পূজোর শঙ্খধ্বনি। কুমোরটুলির কারিগররা মাটি কেটে গড়ে তোলেন প্রতিমা, প্রতিটি আঙুলে মিশে থাকে শিল্প আর বিশ্বাস। এ শহরের প্রতিটি অলিতে গলিতে শুরু হয় আলো আর সাজের প্রতিযোগিতা।
মা আসেন মা কেবল দেবী নন, মা যেন বাঙালির কন্যা, মা আসেন বাপের বাড়ি। এই আবেগই পুজোর প্রাণ। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ভিড় জমে, হাতে ফুচকার জল, মুখে আড্ডার ঝড়, আর চোখে চোখে আনন্দের ঝলকানি।
দুর্গাপুজো মানে শিল্পের উন্মেষ। একেকটা প্যান্ডেল যেন ক্ষণস্থায়ী জাদুঘর। কোথাও তাজমহল, কোথাও গ্রিসের মন্দির, আবার কোথাও বাংলার গ্রাম্য শিল্প সবই উঠে আসে কাঠ, বাঁশ, কাপড় আর আলো দিয়ে। এই অস্থায়ী কাঠামোগুলো ভেঙে যায় কয়েকদিনের মধ্যেই, কিন্তু মানুষের মনে রয়ে যায় চিরকাল।
আর খাবার! ভোগের খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, পায়েস এসব ছাড়া পুজো কল্পনাই করা যায় না। তার সঙ্গে যোগ হয় কাঠি রোল, মিষ্টি আর বিরিয়ানির স্বাদ। উৎসবের এই রঙিন মেলায় খাবারও যেন হয়ে ওঠে ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন।
এই আবেগঘন সময়ে, কলকাতার অগ্রগণ্য শিল্পগোষ্ঠী ঘোষ গ্রুপ এর নেতৃত্বও জানালেন তাঁদের মনের কথা।
চেয়ারম্যান, তনুশ্রী ঘোষ, বললেন:
“দুর্গাপূজো আমাদের সবার আত্মার উৎসব। এখানে ধর্ম, জাত, বয়স কোনো ভেদাভেদ নেই। একসাথে মানুষ যেভাবে শিল্প, সঙ্গীত আর আনন্দে মেতে ওঠে, সেটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রেরণা। আমরা বিশ্বাস করি, মিলিত প্রচেষ্টা আর সৃজনশীলতাই পারে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।”
চেয়ারম্যান এমেরিটাস, বিশ্বদীপ ঘোষ, স্মৃতিমেদুর কণ্ঠে বললেন:
“আমাদের ছোট্ট শুরু ছিল প্রায় চার দশক আগে। আজ যখন দেখি দুর্গাপূজো প্রতি বছর নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে, তখন মনে হয় এ উৎসব আমাদের জীবনকেও শেখায় কীভাবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, অথচ শিকড়ে থাকতে হয় অটল। এই উৎসব আমাদের অধ্যবসায় আর আশার প্রতীক।”
ম্যানেজিং ডিরেক্টর, বিতান ঘোষ, নতুন প্রজন্মের কণ্ঠে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখালেন:
“দুর্গাপূজো মানেই নতুন সূচনা। ঠিক যেমন মা প্রতিবছর ফিরে আসেন আমাদের মাঝে, তেমনি আমরাও চাই নতুন স্বপ্ন, নতুন উদ্যম নিয়ে পথ চলতে। আজ আমরা যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, তখন এই উৎসবই আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের শক্তি এখানেই, আমাদের শহরেই, আমাদের সংস্কৃতিতেই।”
দুর্গাপূজোতে মানুষ ভুলে যায় ভেদাভেদ। ধনী-গরিব, ছোট-বড়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সবাই ভিড় জমায় একসাথে। প্যান্ডেলের সামনে দাঁড়িয়ে সকলে সমান, ঠাকুর দেখার একই উচ্ছ্বাস। এই মিলনই বাঙালির বড় সম্পদ।
স্থানীয় ক্লাবগুলো শুধু প্যান্ডেল গড়ে না, তারা সামাজিক কাজেও যুক্ত হয়। কোথাও রক্তদান শিবির, কোথাও স্বাস্থ্য শিবির, আবার কোথাও মহিলাদের ক্ষমতায়নের বার্তা, সব মিলিয়ে দুর্গাপূজো সমাজেরও পরিবর্তনের হাতিয়ার।
আজকের পূজো ডিজিটালের ছোঁয়ায় আরও উজ্জ্বল। ড্রোনে ওঠে প্যান্ডেলের আকাশদৃশ্য, ইউটিউবে সরাসরি দেখা যায় সারা রাতের আরতি। প্রবাসী বাঙালিরাও তাই দূরে থেকেও জুড়ে থাকেন উৎসবে।
অর্থনীতির দিক থেকেও দুর্গাপূজো বিশাল শক্তি। ফ্যাশন, খাবার, হোটেল, ট্রাভেল—সব মিলিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় এই কয়েক দিনে। অনেক শিল্পীর সারা বছরের জীবিকা নির্ভর করে এই উৎসবের ওপর।
মহিষাসুর মর্দিনী কেবল পৌরাণিক কাহিনি নয়, এটা এক শাশ্বত বার্তা। অন্যায়, অবিচার, ভয় আর অন্ধকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্য আর ন্যায়ের জয় ঘোষণা করে মা দুর্গা। আজকের দিনে, যখন সমাজ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তখন এই বার্তাই আমাদের প্রেরণা দেয় — লড়াই করতে, জিততে, এগিয়ে যেতে।
দুর্গাপুজো মানে কেবল দেবীর আরাধনা নয়, জীবনের আরাধনা। এটি আনন্দের, মিলনের, সৃষ্টির উৎসব।
ঘোষ গ্রুপের তরফ থেকে সবার উদ্দেশ্যে বার্তা:
“আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাদের পরিবারকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। মা দুর্গার আশীর্বাদে আসুক শান্তি, সমৃদ্ধি আর আনন্দ। শুভো পুজো!”





















Be First to Comment