“অনেকেই অনেক জোরে বল পিটিয়েছে। কিন্তু আর কেউ ভিভের মত প্রতিপক্ষ এবং দর্শকের মনে এমন ভয়ের বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারেনি।”
——— প্রয়াত ধারাভাষ্যকার রিচি বেনো
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচাইতে ভয়ানক, আগ্রাসী এবং খুনে মেজাজের ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। যিনি ব্যাট করতেন হেলমেট ছাড়া; ফাস্ট বোলারদের স্বর্ণযুগে যিনি ছিলেন ফাস্ট বোলারদের যম। প্রতিপক্ষের শিরদাঁড়ায় ভয়ের শীতল স্রোত বইয়ে দিতে কেবলমাত্র মাঠে যাঁর উপস্থিতিই ছিল যথেষ্ট। বলছিলাম সময়ের চেয়ে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকা ব্যাটিং জিনিয়াস, ক্যারিবীয় গ্রেট স্যার ভিভ রিচার্ডসের কথা।
পুরো নাম স্যার আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেক্সান্ডার রিচার্ডস। ক্রিকেটে ‘মাস্টার ব্লাস্টার’ বিশেষণটির সার্থক রূপ সর্বপ্রথম তিনিই দিয়েছিলেন নিজের ব্যাটিংয়ে। অ্যাটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স; একেবারে প্রথম বল থেকেই আক্রমণ ছিল যার ব্যাটিংয়ের শেষ কথা। চুইংগাম চিবুতে চিবুতে প্রতিপক্ষের বোলিং লাইনআপকে স্রেফ খুন করতেন যিনি।
ভিভ রিচার্ডসের ব্যাটিংকে বলা যায় পাওয়ার, টাইমিং আর স্টাইলের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। তাঁর ছিল দুর্দান্ত রিফ্লেক্স এবং হ্যান্ড আই কো-অর্ডিনেশন। পাশাপাশি ডেপথ অফ দ্য ক্রিজের ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। ফুল লেন্থের বলে জোরালো ড্রাইভ খেলতে ভালোবাসতেন।
অনসাইড ফ্লিক ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক শট। অফ স্টাম্পের বাইরের একটা গুড লেন্থ বলকে অনায়াসে মিডউইকেট অঞ্চল দিয়ে সীমানাছাড়া করতে পারতেন। কম্পালসিভ পুলার এবং হুকার ছিলেন। বিশেষ করে হুক শটে তাঁকে সর্বকালের সেরাদের একজন বলে মনে করেন অনেকে। হরাইজন্টাল ব্যাটে ‘অ্যাক্রস দ্য লাইন’ শট খেলতে পছন্দ করতেন বলে নিজের আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেন ‘হিটিং অ্যাক্রস দ্য লাইন’!
ভিভের ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান দেখলে অবশ্য এ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। ১২১ টেস্টে ৫০.২৩ গড়ে ৮৫৪০ রান কিংবা ১৪৭ ওয়ানডেতে ৪৭ গড়ে ৬৭২১ রান ভিভের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝানোর জন্য ‘যথেষ্ট’ হলেও ভিভের আসল মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে তাঁর অবিশ্বাস্য স্কোরিং রেটে।
সত্তর-আশির দশকের বোলারদের কাছে ভিভ রিচার্ডস ছিল এক বিভীষিকার নাম। ইংল্যান্ডের সাবেক ফাস্ট বোলার বব উইলিস একবার মজা করে বলেছিলেন, “ভিভ আমার ভালো বলগুলোতে চার মারত, আর বাজে বলগুলোতে ছয়।”
ওয়াসিম আকরামের ভাষায়, “মার্টিন ক্রো, গাভাস্কারদের বিপক্ষে বল করা কঠিন ছিল, কিন্তু ভিভকে বল করতে গেলে রীতিমতো গলা শুকিয়ে আসত আমার।”
ইমরান খানের মতে, “জেনুইন ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে আমার দেখা সেরা ব্যাটসম্যান ভিভ রিচার্ডস।”
সত্তর-আশির দশকে ক্রিকেট মাঠের সবচাইতে আকর্ষণীয় দ্বৈরথগুলোর একটি ছিল ভিভ রিচার্ডস বনাম ডেনিস লিলি। সে যুগে লিলির মত দুর্ধর্ষ ফাস্ট বোলারের চোখরাঙানি উপেক্ষা করার সাহস খুব কম ব্যাটসম্যানই দেখাতে পেরেছেন। ভিভ ছিলেন তাঁদেরই একজন। লিলিকে মোটেই ভয় পেতেন না তিনি।
শুধু বোলারদের কথাই বা বলছি কেন, প্রতিপক্ষের ফিল্ডাররা পর্যন্ত ভিভকে বিশেষ সমীহের চোখে দেখত। সাবেক উইকেটরক্ষক জেফ্রি ডুজনের ভাষায়, “নতুন ব্যাটসম্যান ক্রিজে আসলে সাধারণত ফিল্ডাররা দুই ধাপ এগিয়ে আসে। কিন্তু ভিভের বেলায় দেখেছি তার ঠিক উল্টো। ভিভ নামলে ফিল্ডাররা বরং দুই ধাপ পিছিয়ে যেত।”
ক্রিকেটে একমাত্র ভিভ রিচার্ডসকেই ‘কিং’ উপাধি দেয়া হয়। ক্রিকেট মাঠে তার রাজকীয় পদচারণা দেখলেই বোঝা যায় নামকরণটা যথার্থই। ভিভ রিচার্ডসের ড্রেসিংরুম থেকে মাঠে প্রবেশের পুরো দৃশ্যটাই একটা শিল্পকর্ম। পৃথিবী বিখ্যাত কোরিওগ্রাফার দিয়ে আরো সাউন্ড, লাইট কিংবা ইফেক্ট যোগ করেও সেটা আর ভালো করা সম্ভব নয়। উইজডেনের সাবেক সম্পাদক শিল্ড বেরি বলেছেন, ‘গর্ডন গ্রিনিজ কিংবা ডেসমন্ড হেইন্সের জন্য বরাদ্দ প্রশংসাপত্র দশর্কের করতালিতে অনূদিত হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবে-নিভৃতে, ধীরে-সুস্থে, হেলেদুলে আভিজাত্য আর ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে তিনি মাঠে প্রবেশ করতেন, যেন কোনো সম্রাট তাঁর রাজত্বে ফিরছে।” ভিভ রিচার্ডস হলেন টেস্ট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান যিনি দেড়শ’র বেশি স্ট্রাইক রেটে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। ১৯৮৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জন্মভূমি অ্যান্টিগায় ক্যারিয়ারের বিশতম সেঞ্চুরিটি তিনি তুলে নিয়েছিলেন মাত্র ৫৬ বলে! টেস্ট ক্রিকেটের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড হিসেবে যেটি টিকে ছিল প্রায় ৩০ বছর! অনেকেই হয়ত জানেন না, টেস্ট ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ডটিও একসময় ছিল ভিভ রিচার্ডাসের দখলে। ভিভের ৮৪ ছক্কার রেকর্ডটি টিকে ছিল প্রায় ১৩ বছর; ২০০৪ সালে যেটি ভেঙেছিলেন সাবেক কিউই অলরাউন্ডার ক্রিস কেয়ার্নস। বর্তমানে সেটি ব্রেন্ডন ম্যাককালামের (১০৭) দখলে। ব্যাট হাতে ভিভ যে কেবল বিধ্বংসীই ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের ধারাবাহিক। ১৯৭৬-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫৫ গড়ে রান করেছেন ভিভ। ২৩টি সিরিজ খেলেছেন, যার ১৩টিতেই তাঁর গড় ছিল পঞ্চাশের বেশি। ব্যাটিং গড়ে ভিভ পেছনে ফেলে দিয়েছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল (৫৪), সুনীল গাভাস্কার (৫১), অ্যালান বোর্ডার (৫২), জাভেদ মিয়াঁদাদের (৫৪) মতো অলটাইম গ্রেটদেরও। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস ঘাঁটলে হয়ত ভিভের চাইতে ভাল ব্যাটসম্যান খুঁজে পাওয়া যাবে। যদিও তা সংখ্যায় অতি নগন্য। তবে ওয়ানডেতে যে ভিভই সর্বকালের সেরা এ নিয়ে দ্বিমত করার লোক বোধ হয় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ইয়ান বোথাম, ব্যারি রিচার্ডস, মার্টিন ক্রো, শেন ওয়ার্ন, রবি শাস্ত্রী, নিল ফেয়ারব্রাদার, ডেরেক প্রিঙ্গলদের মতো বিশেষজ্ঞরাও সেরার প্রশ্নে রায় দিয়েছেন ভিভের পক্ষেই। ভিভের ওয়ানডে সেঞ্চুরির সংখ্যা ১১টি; এবং তার সবকটিতেই জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওয়ানডেতে প্রতি ১৫ ইনিংসে অন্তত একটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন তিনি। ভাবছেন এ আর এমন কী! তবে জেনে রাখুন, ভিভের যুগে ১-৭ নম্বর পজিশনে ব্যাট করা ব্যাটসম্যানদের প্রতিটি সেঞ্চুরির জন্য খেলতে হয়েছে গড়ে প্রায় ৫৫ ইনিংস!
অর্জন ও স্মরণীয় কীর্তি:
উইজডেন ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার: ১৯৭৭, ওয়াল্টার লরেন্স ট্রফি: ১৯৮০, ১৯৮৬, অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার: ১৯৯৪, নাইটহুড উপাধি লাভ: ১৯৯৯, উইজডেন মনোনীত শতাব্দীর সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন: ২০০০, ভিভ রিচার্ডসের নামে স্টেডিয়াম নির্মাণ: ২০০৭।
ভিভ রিচার্ডস হলেন ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি ফুটবল (বাছাইপর্ব) এবং ক্রিকেট দুটো বিশ্বকাপেই অংশগ্রহণ করেছেন। যদিও ফুটবল বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব উৎরাতে ব্যর্থ হয়েছিল তাঁর দেশ অ্যান্টিগা।
স্যার ভিভ রিচার্ডস ১৯৫২ সালের আজকের দিনে (৭ মার্চ) সেন্ট জোন্স, এন্টিগুয়া’তে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment