জন্মদিনে স্মরণঃ এ ম এ স শু ভ ল ক্ষ্মী
বাবলু ভট্টাচার্য : গৃহবধূ হয়েও তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। তাঁর ফ্যাশানের প্রধান ধরন ছিল— খোলা চুল, কপালে বড় লাল টিপ, মেরুন-সবুজ-হলুদ রঙের সিল্কের শাড়ি। নাকের দু’পাশে নাকফুল পরতেন এবং তাঁর হাতে সবসময় একটি বড় ফুলের মালা শোভা পেত। এমনকি তিনি নিয়মিত পান খেতেন। বিনম্রতা ছিল তাঁর ভূষণ।
তিনি প্রবাদপ্রতিম কর্ণাটকী কণ্ঠশিল্পী এম এস শুভলক্ষ্মী।
এমএসের আর একটি নাম কুঞ্জআম্মা। তাঁর বাবা-মা বীণা বাজাতেন। আর ঠাকুমা আক্কাম্মাল বাজাতেন ভায়োলিন। কুঞ্জআম্মার মা ছিলেন দেবদাসী সম্প্রদায়ের মেয়ে। নিয়মিত মঞ্চানুষ্ঠানও করতেন তিনি। তিন সন্তান, ভাই ও তাঁদের স্ত্রীদের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে এই কাজটা করতেই হত তাঁকে।
ছোটবেলা থেকেই গানবাজনায় আগ্রহ কুঞ্জআম্মার। প্রথম গুরু তাঁর মা-ই। সেইসময় শিখেছেন সেমমানগুডি শ্রীনিবাস আয়ারের কাছে। পরে হিন্দুস্থানি সঙ্গীত শিক্ষা নেন পণ্ডিত নারায়ণ রাও ব্যাসের কাছে। পরে শেখেন পল্লবী সঙ্গীত। শিক্ষাগুরু ছিলেন এমএস ভাগবতার। এরপরেই মঞ্চানুষ্ঠান শুরু করেন কুঞ্জআম্মা। সেখানে বীণা বাজাতেন মা। মাত্র ১০ বছর বয়সেই কুঞ্জআম্মা তাঁর প্রতিভাকে পরিচিত করান।
১৯৩০ সালে মাকে নিয়ে চেন্নাইতে চলে আসেন কুঞ্জআম্মা। সেখানে সঙ্গীতজ্ঞা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্যে সংগ্রাম শুরু করেন। চেন্নাইতে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় বিশিষ্ট সাংবাদিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী টি সদাশিবমের। ১৯৪০ সালে তাঁকেই বিয়ে করেন। স্বামীর দেশপ্রীতি কুঞ্জআম্মাকেও দেশের স্বাধীনতা লাভের কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জাতীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সেইসময় তিনি জাতীয়তাবাদী গান পরিবেশন করতেন। পরে সি রাজাগোপালাচারীর মাধ্যমে জওহরলাল নেহরু ও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। রাজাগোপালাচারী ছিলেন তাঁর স্বামীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মহাত্মাকে ভজন শুনিয়েছিলেন এমএস শুভলক্ষ্মী।
১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭। এই সময়কালে বেশ কয়েকটি ছায়াছবিতে অভিনয় করেছিলেন এমএস শুভলক্ষ্মী। সেগুলির ভিতর রয়েছে ‘সেবা সদন’, ‘শকুন্তলা’র মতো ছবি। ‘সাবিত্রী’ নামে একটি ছবিতে পুরুষের ভূমিকায় অভিনয় করেন। চরিত্রটি ছিল নারদের। সাবিত্রী সিনেমাটি করা হয়েছিল জাতীয়তাবাদী তামিল সাপ্তাহিক কল্কির প্রকাশ করার উদ্দেশে। ‘মীরা’ ছবিতে মীরাবাঈয়ের ভূমিকাতেও অভিনয় করেছিলেন তিনি।
নিজের শিল্পীসত্তাকে বরাবরই দেশের কাজে নিয়োজিত রেখেছিলেন শুভলক্ষ্মী। শুভলক্ষ্মীর হিন্দিতে গাওয়া ভজনগুলি তাঁকে দক্ষিণ ভারতের গণ্ডি থেকে বের করে এনে সারা দেশে পরিচিতি দেয়। তবে মানুষ হিসাবে তিনি ছিলে নিরভিমানী। বলবার মতো একটি বিষয় হল, কোনওদিন কোনও সংবাদ মাধ্যমকে ইন্টার্ভিউ দেননি শুভলক্ষ্মী।
জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৫৪ সালে পান পদ্মভূষণ, ১৯৭৪ সালে রামণ ম্যাগসেসে, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, ১৯৭৫ সালে পদ্মবিভূষণ, ১৯৮৮ সালে কালিদাস সম্মান, কোণারক সম্মান, সঙ্গীত নাটক একাডেমির ফেলোশিপ, ইন্দিরা গান্ধী অ্যাওয়ার্ড এবং দেশিকোত্তম উপাধিতে সম্মানিত করা হয়েছে তাঁকে।
১৯৯৬ সালে এমএস শুভলক্ষ্মীকে দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার ভারতরত্ন দেওয়া হয়। পুরস্কারের অর্থ বহু ক্ষেত্রে তিনি দান করেছেন সেবামূলক কাজে।
১৯৯৭ সালে স্বামী টি সদাশিবমের মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে গান করা ছেড়ে দেন তিনি।
২০০৪ সালের ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় সঙ্গীত জগতের অন্যতম মহীরুহ এম এস শুভলক্ষ্মী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শিল্পী এম এস শুভলক্ষ্মী ১৯১৬ সালের আজকের দিনে (১৬ সেপ্টেম্বর) দক্ষিণ ভারতের মাদুরাইতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment