ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : বারাণসী,২৬ ফেব্রুয়ারি,২০২৫।
” শ্রীবিশ্বনাথেন সমং ন লিঙ্গম ৷
পুরীনকাশী সদৃশো ত্রিকোটয়াম ৷”
মহাপুরুষ শঙ্করাচার্য ১২ স্বয়ম্ভু লিঙ্গকে জ্যোতির্লিঙ্গ
বলেন ৷ স্বয়ং মহাদেব একটি আলোর শিখায় স্বর্গ , মর্ত্য ও পাতালকে বিদ্ধ করেন ৷ তৈরী হয় জ্যোতির্লিঙ্গ ৷বারোটি জায়গায় বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ বিদ্যমান ৷ এগুলি শিবের একেকটি রূপ ৷ তাঁর মধ্যে প্রথম ও প্রধান “কাশীর বিশ্বনাথ “!বলা হয় পশুপাখি হত্যাকারী এক ব্যাধ জানোয়ারের ভয়ে সন্ধ্যায় গাছের ওপরে মাংসের ঝোলা সহ আশ্রয় নিলে গাছটি থেকে বেলপাতা নিচে থাকা শিবের মাথায় পড়ে ৷ ঘটনাক্রমে ওই দিনটা ছিল “শিব চতুর্দশী ” আর ব্যাধটি ছিল উপবাসী ৷ তাই ব্যাধ “শিবরাত্রি ” উপবাসের ফল পেয়ে মৃত্যুর পর শিবলোক অর্থাৎ স্বর্গে গমন করতে সক্ষম হয় ৷ এই জয়গাটিই কাশীর বিশ্বনাথ ধাম ৷ তাই কোন শিব বা বিষ্ণু ভক্ত শিবরাত্রির উপোস করলে বা বারাণসী ধামে মারা গেলে তাঁর অক্ষয় স্বর্গলাভ হয়৷ কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরটি অনেকবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে ৷ এখনকার মন্দিরটির চূড়া সাড়ে পনেরো মিটার পুরু সোনার পাত দিয়ে মোড়া ৷ তাই একে স্বর্ণ মন্দির বলা হয় ৷ মন্দিররের উত্তরের পবিত্র পাতকুয়োটিকে বলা হয় জ্ঞানব্যাপী ৷ মন্দির ভাঙা হলে এই কুয়োতে স্বয়ং মহাদেব শিবলিঙ্গটি লুকিয়ে ফেলেছিলেন ৷ আগের দিন নিরামিষ খেয়ে কম্বলে বসে বা শুয়ে চার প্রহর জেগে শিবের মাথায় প্রথম প্রহরে দুধ , দ্বিতীয় প্রহরে দই , তৃতীয় প্রহরে ঘি ও চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে শিবকে স্নান করানো হলো “শিবরাত্রি ” পালন ৷ শিবরাত্রি ব্রত করতে হলে আগে সংকল্প করতে হয় -” শিবরাত্রি ব্রতং হোতং করিষ্যেঃ অহং মহাফলং ৷ নির্ব্বিঘ্নম্ অস্তু মে চ অত্র ত্বং প্রসাদাৎ জগৎপতে ৷৷ চতুর্দ্দশ্যাং নিরাহারো ভূত্বো শম্ভো পরেহহানি ৷ ভোক্ষ্যৈঃ অহং মূক্তার্থং শরণং মে ভবেশ্বর ৷৷” এই মন্ত্র বলে ৷ ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি হলো “মহাশিবরাত্রি ” ৷ অর্থাৎ শিবের জন্য রাত্রি ৷ ত্রয়োদশীর দিন একবেলা নিরামিষ খেয়ে তারপর চতুর্দশীতে ব্রত পালন করে তারও পরের দিন পারণ পালনের মধ্য দিয়ে শ্রীশ্রীশিবরাত্রির ব্রত শেষ হয় ৷ রাত জেগে ব্রত কথা শুনে পরদিন দক্ষিণা দিয়ে ব্রাহ্মণ , সন্ন্যাসী বা সৎ ব্যক্তিকে ভোজন করান ব্রতীরা৷ এবারে ২৬ মার্চ বুধবার ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথি অথার্ৎ “মহাশিবরাত্রি”৷ পারণ মন্ত্র -” সংসারে ক্লেশ দগ্ধস্য ব্রতেনানেন শঙ্কর ৷ প্রসীদ সুমীখোনাথ জ্ঞান দৃষ্টি প্রদোভব ” ৷ সর্বত্র শিবস্থানে শিবরাত্রি হয় ৷ বারাণসীতে শিব ও শক্তির জাগ্রত অধিষ্ঠান ৷ হিন্দুদের বিশ্বাস পৃথিবীর প্রাচীনতম নগরী বারাণসী বা কাশীতীর্থ ৷ শ্রীকৃষ্ণের জন্মেরও বারোশো বছর আগে এই নগরী বিদ্যমান ছিল ৷ মন্ত্র না জেনেও যে কেউ শুধু শিবের নাম “শিব শিব ” বলেও জল দিতে পারে ৷
” ওঁ নমো শিবায় ” বলে গঙ্গাজল ও বেলপাতা দিলেই তিনি সন্তুষ্ঠ হন ৷ নীল অপরাজিতা ( নীলকন্ঠ) , আকন্দ , ধুতরো ফুল দুধ , দই , ঘি , মধু ও গঙ্গার জল মহাদেবের বিশেষ প্রিয় ৷ হলুদ, চন্দন , কুমকুম ও নতুন বস্ত্র দিয়ে শিবমূর্তিকে সাজাতে হয় ৷ কর্পূরের প্রদীপ , দীপ ও ধূপ জ্বালাতে হয় ৷ শিবরাত্রির চার প্রহরে চার রকম ব্যবস্থা ৷ প্রথম প্রহরে দুধ ঢেলে শিব লিঙ্গকে “ইদং স্নানীয় দুগ্ধং হৌং ঈষানায় নমঃ “বলে স্নান করাতে হয় ৷ বলা হয় “ইদম্ অর্ঘ্যং ওঁ শিবরাত্রি ব্রতং দেব পূজাজপ পরায়ণঃ৷ করোমি বিধিবৎ দত্তং গৃহাণ্ অর্ঘ্যং মহেশ্বর ” মন্ত্র ৷ দ্বিতীয় প্রহরে দই দিয়ে স্নান করানোর সময় আগের মত মন্ত্রে দুগ্ধের জায়গায় দধি বলতে হয় ৷ মন্ত্র বলতে হয় ,” ইদম্ অর্ঘ্যং ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় সর্ব্বপাপ হরায় চ ৷ শিবরাত্রৌ দদম্য অর্ঘ্যং প্রসীদ সহ ” ৷ তৃতীয় প্রহরে ঘি দিয়ে স্নান করানোর সময় দুগ্ধ / ঘৃতের বদলে বামদেবায় বলতে হয় ৷ মন্ত্র হলো ,” ইদম্ অর্ঘ্যং ওঁ দুঃখ ,দারিদ্র ও শোকেন দুগ্ধোঃ অহং পার্ব্বতীশ্বর ৷ শিবরাত্রৌ দদাম্ অর্ঘ্যম্ উমাকান্ত গৃহাণ্ মে “৷চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে স্নানে একই স্নান মন্ত্রে দুগ্ধ /দধি/ বামদেবায় র বদলে মধু বলতে হবে ৷ তারপর স্নান করাতে হয়, “ইদম্ অর্ঘ্যং ওঁ ময়া কৃত্যান্ অনেকানি পাপানি হর শঙ্কর ৷ শিবরাত্রৌ দদাম্ অর্ঘ্যং উমাকান্ত গৃহাণ্ মে ” মন্ত্রে ৷ আমরা এই শিব রাত্রির দিনে শিব প্রলয় নাচন করেছিলেন ৷ এই রাতেই শিব- পার্বতীর বিয়ে হয় ৷ এই দিনেই তিনি “শিব লিঙ্গ” রূপে প্রকাশিত হন ৷
তিনি “হর” অর্থাৎ জীবের চিত্ত , পাপ এবং কালপূর্ণ হলে জীবনকেও হরণ করেন ৷ শম্ মানে কল্যাণ ৷ তিনি জীবকে যম – ভয় সহ সমস্ত শঙ্কা হরণ করেন ৷ তাই , তিনি” শম্ভু ” ৷ “রুদ্রের অশ্রু ” হলো রুদ্রাক্ষ ৷ যা শান্তি ও পবিত্রতার প্রতীক ৷ শিবের গলার মালা ৷ তাঁর জটা থেকে জ্ঞান ও পবিত্রতার প্রতীক গঙ্গা প্রবাহিত ৷ তাই , তিনি গঙ্গাধর ৷ চাঁদ শান্তি ও নির্মলতার বার্তাবাহী ৷ অর্ধচন্দ্র তাঁর মস্তকে ৷ তাই , তিনি চন্দ্রেশ্বর ৷নীলাভ শরীর – আসলে যে তিনি অনন্ত তা বোঝায় ৷ ডমরু – হলো ইনফিনিটি ৷ তিনি অসীম ও উন্মুক্ত চিন্তা চেতনার উৎস ৷ তিনি মায়ার অধিশ্বর তাই মহেশ্বর ৷ কালেরও কাল তাই মহাকাল ৷ বিশ্বেশ্বর – সারা সংসারের ঈশ্বর ৷
শিবরাত্রি পূজা হলে আমরা মহেশ্বরকে প্রণাম করি ,” ওঁ অবিঘ্নেন ব্রতং দেবং ত্বৎ প্রসাদাৎ সমর্পিতং ৷ ক্ষমস্ব জগতাং নাথ ত্রৈলোক্য অধিপতি হরঃ ৷৷ যৎ ময়া অদ্য কৃতং পুণ্যং তদ্রুৎ অস্য নিবেদিতং ৷ ত্বৎ প্রসাদাৎ ময়া দেব ব্রতম্ অদ্য সমর্পিতং ৷৷ প্রসন্নো ভব যে শ্রীমন্ মৎ ভূতিঃ প্রতিপ্যতাং ৷ ত্বৎ অবলোকেন মাত্রেণ পবিত্রঃ অস্মি ন সংশয়ঃ”৷৷
জয় শিব শঙ্কর , জয় বাবা বিশ্বনাথ ৷ সবাইকে জানাই মহাশিবরাত্রির অভিনন্দন !
” শিব রাত্রি ও কাশীর বিশ্বনাথ “!..

More from CultureMore posts in Culture »
- কলকাতায় আম্বেদকর স্মরণে গুণীজন সম্বর্ধনা ও বিশেষ আলোচনা চক্র….।
- আইসিসিআর এ ক্যালকাটা জার্নালিস্টস ক্লাবের উদ্যোগে ৮ম আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা….।
- সহস্রাব্দের সেরা মনীষী বাবা সাহেব আম্বেদকর স্মরণে সারাদিনব্যাপী অনুষ্ঠান…।
- চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের ত্রয়োদশী তিথি জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র দিন…।
- ঈদ মোবারক….। ঈদ মানে খুশীর জোয়ার, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার অপূর্ব বন্ধন…. ৷
- মহা সমারোহে আয়োজিত হল TV9 বাংলার দ্বিতীয় ‘নক্ষত্র সম্মান’…।
More from InternationalMore posts in International »
- TV9 বাংলার নতুন নিউজ সিরিজ ‘ব্রিগেড-জোরে বরাত ফেরে?’ ….
- জাগো ইন্ডিয়া জাগো ফিটনেস ক্যাম্পেইন – আর নয় অজুহাত, এবার ফিটনেসে মন দাও!….
- মণিপাল হসপিটাল, ঢাকুরিয়া সফলভাবে ৮০% স্পাইনাল কর্ডে চেপে বসা বিরল টিউমার অপসারণ করল, ২৮ বছর বয়সী মহিলার জীবনে ফিরল নতুন আশার আলো….।
- কলকাতায় আম্বেদকর স্মরণে গুণীজন সম্বর্ধনা ও বিশেষ আলোচনা চক্র….।
- আইসিসিআর এ ক্যালকাটা জার্নালিস্টস ক্লাবের উদ্যোগে ৮ম আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা….।
- সহস্রাব্দের সেরা মনীষী বাবা সাহেব আম্বেদকর স্মরণে সারাদিনব্যাপী অনুষ্ঠান…।
More from Writer/ LiteratureMore posts in Writer/ Literature »
- বেলঘরিয়া থিয়েটার একাডেমির ১৫ বছর এবং ডাক্তার অমিতাভ ভট্টাচার্যের অভিনয় জীবনের ৫০ বছর উদযাপন….।
- একুশে ফেব্রুয়ারী….।
- পম্পা সেনশর্মার কিশোর কবিতা সংকলন ‘রং তুলি ক্যানভাস’ প্রকাশিত হলো….।
- The Golden tree of Indrajal….
- কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনাসভা মধুসূদনকে নিয়ে…..।
- Manisha Gir Receives Golden Book Award for her book ‘ Hema – Hamida’….
Be First to Comment