ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫। শিক্ষার ইঁদুর দৌড়ে ল্যাপটপের ইঁদুর নাচিয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসঘরে এযুগের পড়াশোনা ৷ হাতে লেখা
উঠে যেতে বসেছে ৷ অথচ ,আমরা মা সরস্বতীর সামনে হাতে খড়ি দিয়ে শুরু করেছিলাম “লেখাপড়া ” ! আমিও একেবারে ছোট বয়সে দিদার নিবের কলম জল থাকা দোয়াতে কালির বড়ি গুলে লিখেছি ৷ সে সময় বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় কালির বড়ি ও ব্লটিং পেপার ছাত্রদের দেওয়া হত ৷বাড়ীর বড়রা বলতেন ,” হাতে কালি মুখে কালি / তবে জানব লিখে এলি !” তখন সব মানুষ তথাকথিত সাক্ষর না হলেও প্রকৃত শিক্ষার অভাব ছিল না ৷ অশিক্ষিত মানুষও রামায়ণ , মহাভারত , ভাগবতের
কাহিনী জানতেন ৷ জীবনে সে শিক্ষার প্রয়োগও করতেন ৷ তৈত্তিরীয় উপনিষদে পড়াশুনার গুরুত্ব বলা হয়েছে ,”সত্যং বদ, ধর্মং চর , স্বাধ্যায়ন মা প্রমদঃ “( সত্য বল, ধর্ম পালন কর , অধ্যায়ন থেকে বিরত হয়ো না ) ৷ শিক্ষার আসল লক্ষ্য অমৃত সংগ্রহ করা ( “যেনাহং নামৃতস্যাম , তেনাহং কিম কুর্যাম”) ৷বিমূর্ত থেকে মূর্তে যাওয়া বা “From abstract to concrate. গুরু গৃহে থেকে বিনা পারিশ্রমিকে গৃহকাজ , গরু চড়ানো , ফল, ফুল ,
লতা , পাতা তুলে এবং সেবা করে প্রাচীন ভারতে শিক্ষা
গ্রহণ করতে হত ৷ মুখে মুখে শুনে সেই শিক্ষার জন্য বেদের আরেক নাম ছিল” শ্রুতি “৷ শিক্ষা শুধু
রোজগারের প্রধান উপকরন নয় ৷ যাকে গান্ধীজী
বলেছিলেন ,”Education is an alround development of the child best in body , mind and spirit . হজরত মহম্মদ শিক্ষা লাভের
জন্য ১৫০০ বছর আগে বলে গেছেন প্রয়োজনে চীনে যেতে ৷ মক্তব , মাদ্রাসা গুলিতে কোরান , আরবি শিক্ষার সাথে প্রকৃত মানুষ হওয়ার শিক্ষাও দেওয়া হত ৷ ক্যাথলিক বিশ্বে ক্যাথিড্রালগুলি ছিল শিক্ষালয় ৷ আগে পাঠশালায় ছেলেরা বসার জন্য চটের বসার আসন এবং লেখার জন্য চওড়া তালপাতা যাকে বলত”পাত-তাড়ি” বগলে এবং হাতে ভুষো কালি ভর্তি মাটির ভাঁড় এবং সরকাঠি বা কঞ্চির কলমবাড়া ( কলম) নিয়ে পাঠশালায় যেতেন ৷ যা ছিল সে যুগের Teacing contents and teaching aids ” . এখনও কিছু বৃদ্ধ মানুষের সেই সুখ স্মৃতি বিদ্যমান ৷আমি মায়ের মুখে শুভঙ্করের (যাঁর আসল নাম ভৃগুরাম দাস) আর্যা বা ছড়া মুখস্থ বলতে শুনেছি ৷ আমাদের মেট্রিক যুগে তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়৷
তবু , এ নিয়ে বাংলাদেশের একটি গান ” জানতাম
যদি শুভঙ্করের ফাঁকি , আমার ভাগে পড়ত না
ভাই শূণ্য ” আমিও ছেলেবেলায় গেয়েছি ৷ আদিম যুগে মানুষ শিকার করে এনে সবাই মিলে ভাগ করে তা আগুনে ঝলসে খেত ৷আর শিকারীরা বলত তাদের শিকারের অভিজ্ঞতা ও প্রতিকূল পরিস্থিতির বর্ণনা ৷ যাকে ল্যাটিনে বলা হয় ” Shkhol” বা ‘স্খোল” ৷ যা থেকে উৎপত্তি ইংরেজি স্কুল শব্দের ৷ Education শব্দটাও ল্যাটিন “এডুকেয়ার “বা “এডুকাতুম “থেকে এসেছে ৷ ইউরোপে প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন প্লেটো গ্রীসের এথেন্সে ৷ সক্রেটিস বলেছিলেন ,”শিক্ষা হল
মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ “৷ যা এরিস্টটলের কাছে ছিল ,” সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরী করা ” ৷সেটাই বিবেকানন্দের ভাষায় “পূর্ণতা ” !
“Education is the manifestation of the perfection already in man ” ! পূর্ব ইউরোপে
কনফুসিয়াস নীতি কথার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো
ছড়িয়েছিলেন ৷ যে শিক্ষা চীনকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ৷ মিশরে মিডল কিংডমের সময় স্কুল চালু হয় ৷ আমাদের দেশে তক্ষশিলা , নালন্দা , বিক্রমপুর হয়ে উঠেছিল দেশবিদেশের বিদ্যার্থীর কেন্দ্রস্থল ৷ পাশ্চাত্যে তা অনেক পরে ৷
১০৮৮ খ্রিস্টাব্দে বলোনি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে ৷ আজ মানব সভ্যতা গ্রহান্তরে পাড়ি দিচ্ছে তার
ভিত্তি এভাবে তৈরি হয় ৷ তবে , কর্পোরেট দুনিয়ায়
শিক্ষা জ্ঞান লাভের চেয়ে হয়ে উঠেছে টাকা কামানোর
উপায় ৷ শুধু রোজগার নয় জ্ঞানের আলোয়
উদ্ভাসিত হোক আগামী প্রজন্ম ৷ এখন থেকে ছোট
দের সে শিক্ষা দিন !
” TEACHER “means , T- Truthful ( সত্যবাদী),
E- Educated ( শিক্ষিত) , A- Active ( সক্রিয় ),
C- Character ( চরিত্রবান) , H- Honest ( সৎ),
E- Energetic ( উদ্যোগী) , R- Responsible
( দায়িত্ববান ) ৷আবার “শিক্ষক ” শব্দটি বিশ্লেষণ
করলে পাই – শি- শিষ্টাচার , ক্ষ- ক্ষমাশীল ,
ক- কর্তব্য পরায়ণ ৷ শিক্ষকরা হলেন – T- Talented , E- Elegant , A- Awesome , C- Charming , H- Helpful , E – Efficient , R -Receptive ব্যক্তি ৷ সমাজে সবচেয়ে সম্মানিত ৷
৫ ই সেপ্টেম্বর ভারতে “জাতীয় শিক্ষক দিবস “৷
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিনটি ১৯৬২ সাল থেকে ভারতে “শিক্ষক দিবস ” হিসাবে পালিত হয়৷ সেসময়ে জন্ম নথিভুক্তির প্রচলন না থাকায় অনেকেরই আসল জন্মদিন আর কাগুজে জন্মদিনে তফাৎ দেখা যায় ৷ রাধাকৃষ্ণাণ ১৮৮৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জন্মেছেন এটা মানা হলেও তাঁর ছেলে ড. সর্বপল্লী গোপাল বাবার জন্মদিন ১৮৮৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর লিখেছেন ৷ যাহোক বিখ্যাত শিক্ষক সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ দেশের রাষ্ট্রপতি হলে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তাঁর জন্মদিন সাড়ম্বরে পালনের আবদার জানালে রাধাকৃষ্ণণ বলেন তাঁর জন্মদিন নয় যে শিক্ষাকতাকে তিনি সবচেয়ে শ্রদ্ধা করেন সেই শিক্ষক সমাজকে এই দিন শ্রদ্ধা জানানো হোক ৷ সেই ১৯৬২ সাল থেকে তাই ভারত জুড়ে শুরু হয় ” শিক্ষক দিবস” পালন ৷ এভাবেই হয় অন্ধ্র ও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য , ভারতরত্ল রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে দেশের শিক্ষক সমাজের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন৷ তামিলনাড়ুর তিরুথান্নিতে এক গরিব ব্রাহ্মণ পরিবারে ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণনের জন্ম ৷ তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল “বেদান্ত দর্শনের বিমূর্ত পূর্বকল্পনা “৷ তিনি মহীশূর , অক্সফোর্ড ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন ৷ শিক্ষকের পুরানো নাম “গুরু ” ৷”গু” মানে অন্ধকার বা অজ্ঞতা ৷ আর “রু” অর্থ যিনি অন্ধকার বা অজ্ঞতা দূর করেন ৷ সুপ্রাচীন কাল থেকে এদেশে শিক্ষক দিবস ছিল “গুরু পূর্ণিমা ” ঋষিদের বাণীগুলি শিষ্যরা শুনে মনে রাখতেন বাবা ও মায়ের পর শিক্ষাগুরুকেই সবচেয়ে বেশী শ্রদ্ধা করতেন ৷আমাদের দেশে প্রাচীন কাল থেকে যিনি বেদকে বিভাজন করেছিলেন ও মহাভারত লিখেছিলেন সেই “বেদব্যাসের ” জন্মতিথি “ব্যাস পুর্ণিমা ” পালিত হয় গুরু পূর্ণিমা রূপে ও৷ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে শিক্ষক দিবস পালিত হয় ৷ ব্রিটেন , রাশিয়া , পাকিস্তান , জামার্নির মত ২১ টি দেশে ৫- ই অক্টোবর ৷ইউনেস্কো স্বীকৃত এটাই “বিশ্ব শিক্ষক দিবস “৷বিদেশে প্রথম শিক্ষক দিবস পালন করে লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা ৷ তারা ১১ সেপ্টেম্বর ডোমিনো ফসটিনো সার্মেন্তোর মৃত্যু দিনে দিবসটি পালন শুরু করে ৷ আর , সৌদি আরব , মিশর , লিবিয়া , জর্ডন সহ ১১টি আরব দেশে ২৮ ফেব্রুয়ারি “শিক্ষক দিবস ” পালন করা হয় ৷ আমরা যে যে পেশায় আছি সবক্ষেত্রে প্রধান অবদান শিক্ষকদের ৷ একজন ভালো ছাত্র দরদী শিক্ষক একজন বিদ্যার্থীর জীবন পাল্টিয়ে দিতে পারেন ৷ শিক্ষক দিবসে আমার সব শিক্ষককে আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানাই ৷প্রথম শিক্ষক মা ও বাবা সহ বিশ্বের যাঁর কাছে যখন যা শিখেছি সেই গুণী মানুষ তথা শিক্ষকদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন ৷পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় পেশা শিক্ষাকতায় যুক্ত প্রত্যেককে আমার অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন ৷”গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরু দেব মহেশ্বর , গুরু সাক্ষাৎ পরম ব্রহ্ম তস্ময়ী শ্রী গুরুবে নমঃ৷
HAPPY TEACHER’S DAY TO ALL.
Be First to Comment