——————–স্মরণঃ শমিত ভঞ্জ—————–
বাবলু ভট্টাচার্য : তিনি ছিলেন যৌবনের দূত। বাংলার ‘দামাল ছেলে’। অভিনয় করবেন বলে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়েছিলেন। নিজের বেকারত্বকে পাত্তা না দিয়ে কলেজ পড়ুয়া প্রেমিকাকে বিয়ে করেছিলেন জেদের বশে। অনুমতির তোয়াক্কা না করে, তপন সিংহের মতো নামী পরিচালকের ঘরে ধাক্কা দিয়ে ঢুকে বলেছিলেন, “অভিনয় করতে চাই।” তিনি শমিত ভঞ্জ। শমিত ভঞ্জ ১৯৪৪ সালের ২ জানুয়ারি জামসেদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা প্রীতিময় ভঞ্জ ও মা শীলা। তমলুকে জন্মালেও শমিতের স্কুলে যাওয়া শুরু হয়েছিল জামশেদপুরের লয়েলা স্কুলে। কারণ, তখন কর্মসূত্রে তাঁর বাবা জামশেদপুরেই থাকতেন।
অভিনয় করার ঝোঁকটা ছিল ছোট থেকেই। আর সিনেমায় অভিনয় করার ইচ্ছেটা তাঁর পাড়া বা স্কুলের নাটকে অভিনয় করতে করতেই জন্ম নেয়। তাই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ঝাড়গ্রাম পলিটেকনিক কলেজে পড়ার সময়ই কলকাতায় আসার ইচ্ছেটা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। পলিটেকনিকে পড়া শেষ না করেই শমিত কলকাতায় চলে আসেন। তার পর পড়াশোনাই ছেড়ে দেন। একদিন মরিয়া হয়ে তপন সিংহের অফিসে ঢুকতে চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু তাঁর সহকারী বলাই সেন তাঁকে ভাগিয়ে দিলেন। কিন্তু সহজে হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না শমিত। একদিন সুযোগ বুঝে টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োয় তপনবাবুর ঘরে জোর করে ঢুকে পড়েছিলেন। সটান তপন সিংহর সামনে গিয়ে হাজির হয়ে বলে বসলেন, “কাজ করব, কাজ দিন।” ভদ্র অমায়িক তপনবাবু বলেছিলেন, “এখন তো ছবি আরম্ভ হয়ে গেছে। পরে যোগাযোগ কোরো।” তপন সিংহ তাঁকে হতাশ করেননি। শমিতকে ‘হাটে বাজারে’ ছবিতে একজন মোটর মেকানিকের চরিত্রে নির্বাচন করেছিলেন। এই ছবিতে অশোককুমার ও বৈজয়ন্তীমালার মতো তারকার সঙ্গে যে সাবলীল অভিনয় তিনি করেছিলেন, তা দেখলে অবাক হতে হয়! এই ছবি করতে এসেই আলাপ হয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শচীন অধিকারীর ‘শপথ নিলাম’ ছবিতে বিপ্লবী শহিদ দীনেশ মজুমদারের চরিত্রে অভিনয় করার পরই শমিতের অবস্থার বদল ঘটতে শুরু করেছিল। এই ছবিতে শুটিং করার সময়ই একদিন তাঁকে রবি ঘোষ খবর দিয়েছিলেন, “মানিকদা তোকে খুঁজছেন”।
সত্যজিতের সঙ্গে শমিতের পরিচয় ছিল না। কোথায় থাকেন তাও জানতেন না। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় শমিতকে সত্যজিতের লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এর পরই বাংলা সিনেমায় আরও একটি অনবদ্য চরিত্র ‘হরি’র জন্ম হয়েছিল। শমিত ভঞ্জ ‘আপনজন’-এর পর তাঁর অভিনয় জীবনের আরও এক মাইল ফলক ছুঁয়ে ফেলেছিলেন। শমিতের নিজের কথায়, “যে মুহূর্তে খবর ছড়াল সত্যজিৎ রায় আমাকে নিয়েছেন, অমনি যেন টালিগঞ্জের লোকেরা নড়েচড়ে বসল।” ১৯৭১-এ শমিতের মুক্তি পাওয়া ছবির সংখ্যা চার। যার মধ্যে ‘জননী’, ‘আটাত্তর দিন পরে’, দীনেন গুপ্তর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ যেমন রয়েছে, তেমনই আছে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দি ছবি ‘গুড্ডি’। এই ‘গুড্ডি’ দিয়েই শমিতের হিন্দি সিনেমার জগতে প্রথম পা রাখা। এর পর আরও তিনটি হিন্দি ছবিতে তিনি কাজ করেন। ‘ওহি রাত ওহি আওয়াজ’, ‘অনজানে মেহমান’ ও ‘কিতনে পাস কিতনে দূর’।১৯৭২-এর পর থেকে ’৯৫ পর্যন্ত প্রতি বছরই শমিতের চার থেকে পাঁচটি করে ছবি মুক্তি পেতে থাকে। তার মধ্যে তপন সিংহের ‘হারমোনিয়াম’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, তরুণ মজুমদারের ‘ফুলেশ্বরী’, ‘গণদেবতা’, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘ফেরা’ যেমন রয়েছে, তেমনই আছে সাধারণ বাংলা বাণিজ্যিক ছবিও। শমিতের জীবনের শেষ ছবি ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আবার অরণ্যে’। পরিচালক গৌতম ঘোষ। ইতিমধ্যে তিনি সিনেমার বাইরে ওয়ান-ওয়াল থিয়েটার ও যাত্রায় অভিনয় করেছেন।
১৯৯৫ সালে তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত দু’টি ছবির নাম যথাক্রমে ‘প্রতিধ্বনি’ ও ‘মোহিনী’। একটি ছবি তিনি নিজেই পরিচালনা করছিলেন। সেটি হল ‘উলটো পালটা’। ছবিটি শেষ করা হয়নি। হয়তো এই সময় থেকেই তাঁর শরীর তেমন ভাল যাচ্ছিল না। ১৯৯৮-’৯৯ সাল নাগাদ তাঁর কোলন ক্যানসার ধরা পড়ে।
শমিত ভঞ্জ ২০০৩ সালের আজকের দিনে (২৪ জুলাই) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment