সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : কলকাতা,২২মে২০২২। রাজা রামমোহন রায়ের ২৫০ তম জন্মদিন । যদিও জন্ম বয়স নিয়ে একটা বিতর্ক থেকেই গেছে, কেননা অনেকে বলেন রামমোহনের জন্ম বছর ১৭৭৪। সে অর্থে ২৫০তম জন্মদিন পালিত হওয়ার কথা ২০২৪ সালে। কিন্তু মেরুদন্ডযুক্ত বাঙালি হিসেবে রামমোহন যে ইতিহাসে চর্চিত হবেন সে ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই। সবচেয়ে অবাক হওয়ার মত কথা, বাংলার যে নারীজাতিকে হিন্দু ধর্মের বিধান দেখিয়ে একাধারে শোষণ ও অত্যাচার চালানো হতো, সেই অত্যাচারের অন্যতম নৃশংস উদাহরণ ছিল, সতীদাহ প্রথা। যা রদ করেন রামমোহন। অথচ সেই রামমোহনের মা তারিণীদেবী নিজে একজন নারী ও মা হওয়া সত্ত্বেও নিজের ছেলে রামমোহনের মৃত্যু কামনা করে বলেছিলেন, আমি চাই রামমোহনের শিরোচ্ছেদ করা হোক। সমাজ, আত্মীয়,এমন কি মা ছেলের মৃত্যু কামনা করছেন। কি এমন অপরাধ করেছিলেন রামমোহন?
রামমোহনের অপরাধ ছিল দুটি। এক,হিন্দু ধর্মের ত্রুটিগুলি তিনি সমালোচনা করতেন। দুই,পাল্টা যুক্তি দিয়ে সরাসরি হিন্দু ধর্মের ত্রুটির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সমঝোতা করেননি। শুধু হিন্দু ধর্মই নয়, খ্রিস্টান ধর্মের ত্রুটি ধরে ব্রিটিশেরও চক্ষুশূল হয়েছিলেন রামমোহন। তিনি তাঁর একেশ্বরবাদের প্রচারে যীশুর অলৌকিক তত্ত্বের বিরুদ্ধে একটি বই লেখেন। পার সেক্টস অফ জেসাস গাইড টু পিস অ্যান্ড হ্যাপিনেস। এই গ্রন্থে তিনি যীশুর ঐশ্বরিক অলৌকিকত্বকে অস্বীকার করায় খ্রিস্টান পাদ্রীদের বিরাগভাজন হন। সেই সময়ের ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা ফ্রেন্ড ওফ ইন্ডিয়ায় রামমোহনের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করেন উইলিয়াম কেরি ও মার্শাম্যান।রামমোহন ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস থেকে তাঁর বই ছাপতেন। তিনি যখন এই প্রেস থেকে তাঁর ফাইনাল অ্যাপিল বইটি ছাপতে যান, প্রেস ছাপতে অস্বীকার করে। রামমোহন নিজেই তখন ইউনিটেরিয়ান প্রেস তৈরি করে দ্বিগুণ উৎসাহে বই ছাপা শুরু করেন।
পরিণত বয়সে রামমোহন যখন সতীদাহ প্রথা সহ হিন্দু ধর্মের নষ্টামি নিয়ে আন্দোলনে নামেন, তাঁর মা তারিণীদেবী মনে করেন ছেলে বিধর্মী হয়ে গেছে।মামলা করে ছেলেকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে চান। রামমোহন মায়ের সিদ্ধান্তে ব্যথা পেলেও তাঁর দৃঢ়চেতা মন তাঁকে টলাতে পারেনি। তাঁর যুক্তিবাদী মন বলে, রামমোহন তুমি মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করছো না, তুমি লড়ছো ধর্মের ভন্ডামীর বিরুদ্ধে। আদালতে দাঁড়িয়ে রামমোহনের গর্ভধারিনী বলেছিলেন, ধর্মত্যাগী পুত্রের মস্তক যদি ছিন্ন করা হয়, তাহলে তা আমি পূণ্য কাজ বলে মনে করবো। কিন্তু আইন তো আবেগ বা ধর্মের বিধান মেলে চলে না। রামমোহনের জয় হয়। রামমোহন সম্পত্তির অধিকার পেয়ে আবার মাকে ফিরিয়ে দেন। তারিণী দেবী যে প্রথম ছেলের বিধর্মী হওয়ায় শঙ্কিত হন তা নয়।
রামমোহন রায়ের আসল পদবী ছিল বন্দোপাধ্যায়। জন্ম সাবেক বর্ধমানের খানাকুল কৃষ্ণগঞ্জে। পিতার নাম রামকান্ত বন্দোপাধ্যায়। প্রপিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ছিলেন বাংলার স্বাধীন নবাব দরবারের মুৎসুদ্দী। নবাবের সন্তুষ্টির কারণে তিনি রায় উপাধি পান। রামমোহনের দাদামশাই অর্থাৎ তারিণীদেবীর বাবা শ্যাম ভট্টাচার্য অভিশাপ দেন, তাঁর নাতি হবে বিধর্মী। জনশ্রুতি, বাপের বাড়িতে একবার ছোট্ট রামমোহনকে নিয়ে যান তারিণীদেবী। নিত্যপুজোয় বসেছিলেন দাদামশাই। ছোট্ট নাতি শিশুসুলভ আচরণে হাতে দেওয়া বেলপাতা মুখে পুরে দেন ছোট্ট রামমোহন। তারিণীদেবী ছেলের আচরণে রেগে রামমোহনের মুখ থেকে বেল পাতা ফেলে দেন মাটিতে। ছেলের গালে বসান এক চড়। বেজায় ক্ষেপে যান ভট্টাচার্য মশাই। মেয়েকে বললেন, আমার পুজোর বেলপাতা তুই মাটিতে ফেলে দিলি, তুই এই ছেলেকে নিয়ে সুখী হবি না। তোর ছেলে বিধর্মী হবে। পরমুহুর্তে চমকে ওঠেন । তিনি একি করলেন? কন্যার দোষে অভিশাপ দিলেন নিষ্পাপ শিশু রামমোহনকে? পিতার পায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারিণীদেবী। শ্যাম ভট্টাচার্য তখন বলেন, বিধর্মী হলেও এই পুত্রের জগৎজোড়া খ্যাতি হবে। পণ্ডিত হবে। সেই অল্প বয়সেই হয়তো পরিবার আত্মীয়, সমাজ সবার সঙ্গে রামমোহনের বৈরিতার বীজ বপন হলো।
যৌবনের শুরুতেই রামমোহন বুঝেছিলেন , দেশে অশিক্ষার কালো মেঘে ঢাকা পড়ে গেছে মানুষের যুক্তিবোধ। ধর্মের কুসংস্কার আর বিদেশি শাসনের জালে বন্দী মানুষ। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে তিনি সিদ্বান্ত নেন, বিদেশি ইংরেজি ভাষায় মানুষকে শিক্ষিত করে কুসংস্কার মুক্ত করতে হবে। আমরা জানি সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে রামমোহনের অবদান অবিস্মরণীয়।১৮১০এর ৮এপ্রিল (১২১৬,২৭ চৈত্র) রবিবার সহমরণে পাঠানো হয় রামমোহনের বড় ভাই জগমোহনের মৃত্যুতে তাঁর স্ত্রী অলোকমঞ্জরী দেবীকে। তথ্য বলছে, রামমোহন বাধা দিতে গেলে লাঠিয়ালদের ঘায়ে আহত হন। আবার অন্য তথ্য বলে, রামমোহন তখন ছিলেন, রংপুরে।
এদেশে কবে প্রথম সতীদাহ প্রথা চালু হয়, তার নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তবে মহাভারতে মাদ্রির সহমরণের কথা পাই। কৃষ্ণের চার স্ত্রী দেবকী, ভদ্রা, মদিরা ও রোহিণী সহমরণে যান। যাইহোক, যেটুকু ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০শতাব্দী থেকে এই প্রথা ছিল। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের সঙ্গে ভারতে এসেছিলেন ক্যাসনিন্দ্রায়ার ঐতিহাসিক এরিস্ত্রবুলুস তাঁর উচ্চারণে টাক্সিলা ( তক্ষশীলা) শহরের সতীদাহ প্রথার বর্ণনা দিয়ে গেছেন। গ্রিক সেনানায়ক ইউমেনেস লিখেছেন, এক ভারতীয় সেনার মৃত্যুতে তাঁর দুই স্ত্রী স্বইচ্ছায় সহমরণে যান। সময়টা ছিল ৩১৬ খ্রিস্টাব্দ। পরবর্তী সময়ে মোঘল আমলে জাহাঙ্গীর ও ঔরঙ্গজেব রামমোহন তাই বৈদিক শাস্ত্রের উল্লেখ করে গ্রন্থ লেখেন শিবনাথ রায় নামে। এই সময়েই বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন রামমোহন রায়। বাধ্য হয়ে কলকাতায় এসে চাকরি নেন এক মহাজনের কাছে। ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ পর্যন্ত ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন রামমোহন । সেই সময় ফার্সি ভাষায় লেখেন একেশ্বরবাদের কথা তুহফাতুল মুহাহহিদিন ।ভূমিকা লেখেন আরবিতে ইতিমধ্যে হিন্দু ধর্মের নিদানকারী মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ও একদল ধনী বাঙালি বিরোধিতা শুরু করেন । রামমোহন ততদিনে ইসলাম, খ্রিস্টান ও বৈদিক ধর্মের সারবত্তা নিয়ে ১৮২৮ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন ব্রাহ্মসমাজ।
সহমরণের বিরুদ্ধে রামমোহনের যুক্তি খন্ডাতে না পেরে রক্ষণশীল হিন্দুবেত্তারা হিংস্র হয়ে ওঠেন। রামমোহনের উত্তর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে জড়ো হয়ে মুরগির ডাক ডাকত। বাড়িতে গরুর হাড় ছুঁড়ে ফেলত। অশ্লীল গান গেয়ে বাড়ি প্রদক্ষিণ করতো। বাধ্য হয়ে ঘোড়ার গাড়িতে রামমোহন যখন বেরোতেন সঙ্গে রাখতেন লাইসেন্স নেওয়া রিভলবার। হিন্দু ধর্মের বিধানে বেদ পাঠ একমাত্র ব্রাহ্মণদের জন্য বিধান ছিল।বাকিরা শুদ্র। মনু বিষণ দেন শুদ্র বেদ পাঠ করলে তাঁদের কানে যেন তপ্ত সীসা ঢেলে দেওয়া হয়। তাই যুগযুগ ধরে ব্রাহ্মণরাই শুধু বেদপাঠ করতেন। সেই নিয়ম ভাঙেন রামমোহন। বেদ বাংলা অনুবাদ করেন। ইংরেজিতে বেদান্ত অনুবাদ করে ভূমিকা লিখতে গিয়ে রামমোহন লেখেন, আমি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করে বিবেক ও সরলতার আদেশে যে পথ অবলম্বন করেছি , তাতে আমার প্রবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন আত্মীয়গণের তিরস্কার ও নিন্দার পাত্র হতে হলো। কিন্তু যাইহোক না কেন, আমি এই বিশ্বাসে ধীরভাবে সমস্ত কিছু সহ্য করতে পারি যে একদিন আসবে, যখন আমার এই সামান্য চেষ্টা লোকে ন্যায় দৃষ্টিতে দেখবে।
সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে লড়তে ইংল্যান্ডে যেতে হবে। নেই অত টাকা। সুযোগ এসে গেল হঠাৎ। দিল্লির সিংহাসনে তখন মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হঠাৎ মোঘল রাজাদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় আর্থিক বিপদে পড়েন মোঘল সম্রাট। তিনি চাইছিলেন একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি যান ইংল্যান্ডে আদালতে তাঁর হয়ে মামলা লড়তে। সম্রাটের খরচে ইংল্যান্ড গেলেন রামমোহন। তাঁর ক্ষুরধার যুক্তিতে হার মানেন হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি। মোঘল সম্রাটের মামলাও জেতেন রামমোহন। মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাঁকে রাজা উপাধি দিয়ে সম্মান জানান।
অনেকের ধারণা রামমোহন ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেও সেই ধর্ম নাকি হিন্দু ধর্মের অনুসারী। যা নিতান্তই ভুল। বৈদিক ধর্ম আর হিন্দু ধর্মে বিস্তর ফারাক। হিন্দু জাতি আর হিন্দু ধর্ম এই বিষয় দুটি এখনও অনেকে গুলিয়ে ফেলেন। হিন্দু ধর্মের পুতুল পুজো সম্পর্কে কি বলেছিলেন রামমোহন রায়? সেসব নিয়ে আলোচনা আগামীকাল।
( শেষাংশ আগামীকাল)
Be First to Comment