সঙ্গীতা চৌধুরী: কলকাতা, ১ নভেম্বর, ২০২২। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। জগদ্ধাত্রী দেবী দুর্গারই একটি রূপ। তবে জগদ্ধাত্রী পুজোর নিয়ম একটু ভিন্ন ধরনের। দুটি প্রথায় এই পুজো হয়। যেমন- কেউ কেউ সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত দুর্গাপুজোর মতোই জগদ্ধাত্রী পুজো করে থাকেন। আবার কেউ কেউ নবমীর দিনই তিনবার পুজোর আয়োজন করে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পুজো সম্পন্ন করেন। যদিও এই পুজোর অনেক নিয়মই দুর্গাপুজোর মত। কোথাও কোথাও এই পুজোর সময় কুমারী পুজোরও প্রচলন আছে। এমনকি পুষ্পাঞ্জলি ও প্রণাম মন্ত্রসহ পুজোর অনেক মন্ত্রও দুর্গাপুজোর অনুরূপ।
জানা যায় উপনিষদে এই দেবীর নাম উমা হৈমবতী। বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরান গ্রন্থেও তার উল্লেখ পাওয়া যায়। ভাগবত পুরান ও অন্যান্য পুরান মতে, দেবী সম্পর্কে উল্লিখিত একটি উপাখ্যান থেকে জানা যায় একবার দেবাসুর সংগ্রামে দেবগন অসুরদের পরাস্ত করলেন। কিন্তু তারা বিস্মৃত হলেন যে নিজ শক্তিতে নয়, বরং ব্রক্ষ্মের শক্তিতে বলীয়ান হয়েই তাদের এই জয়। ফলস্বরূপ তাঁরা অহংকার- প্রমত্ত হয়ে উঠলেন। সেই সময় দেবী লক্ষ্মী এক কুমারী বালিকার রূপ ধারণ করে তাদের সামনে উপস্থিত হন।
দেবী একটি তৃনখন্ড দেবতাদের সামনে পরীক্ষার জন্য রাখলেন। অগ্নি ও বায়ু তাদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও সেই তৃনখন্ডটিকে দগ্ধ বা বিধৌত করতে পারলেন না। তখন বালিকার পরিচয় জানার জন্য দেবগন ইন্দ্রকে সেখানে প্রেরণ করলেন। কিন্তু ইন্দ্র অহংকার- প্রমত্ত না হয়ে জিজ্ঞাসু হিসেবে বালিকার কাছে এসেছিলেন। তাই ব্রক্ষ্মরূপী দেবী মহালক্ষ্মী তার সম্মুখ থেকে তিরোহিত হলেন। আর তার সম্মুখের আকাশে দিব্য স্ত্রীমূর্তিতে হৈমবতী রমা আবির্ভূত হলেন। রমা ব্রক্ষ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে ইন্দ্রের জ্ঞান পিপাসা নিবৃত্ত করলেন। এই দেবীই পুরানে জগদ্ধাত্রী নামে পরিচিতি লাভ করেছেন। জগদ্ধাত্রী অর্থাৎ যিনি জগৎ -কে ধারণ করেন।
জগদ্ধাত্রী পুজো বাঙালিদের একটি বিশেষ উৎসব হলেও, দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর তুলনায় এই পুজোর প্রচলন ঘটেছে আধুনিক কালে। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে কৃষ্ণনগরে এই পুজোর প্রচলনের পরেই ধীরে ধীরে এই পুজোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। তবে দেবী জগদ্ধাত্রী যে বাঙালির কাছে একেবারে অপরিচিত ছিলেন, তা নয়। কারণ তার বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে শূলপাণি কালবিবেক গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পুজোর উল্লেখ করেন। তাছাড়া পূর্ববঙ্গের বরিশালে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তর মূর্তি পাওয়া যায়। জানা যায় সেই মূর্তিটি বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে রক্ষিত আছে। আবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে নির্মিত নদিয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দির ও কোতোয়ালি থানার রাঘবেশ্বর শিব মন্দিরের ভাস্কর্যে জগদ্ধাত্রী দেবীর মূর্তির নিদর্শন পাওয়া যায়। তবে কৃষ্ণচন্দ্রই বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোকে জনপ্রিয় করে তোলেন। কথিত আছে পূর্বে কেবল কিছু ব্রাক্ষ্মন গৃহে দুর্গাপুজোর পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী পুজো হতে দেখা যেত।
তবে বর্তমানে কৃষ্ণনগর, চন্দননগর, জয়রামবাটী সহ বাংলার বিভিন্ন স্থানে দারুণ আড়ম্বরের সঙ্গে জগদ্ধাত্রী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতাও এখন জগদ্ধাত্রী পুজোর উৎসবে মেতে থাকে। কালীপুজোর পরই এই পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। বেশিরভাগ স্থানেই নবমীর দিনই পুরো পুজোর আয়োজন করা হয়। অনেকেই খুব নিষ্ঠা সহকারে সকাল থেকে পুজোর প্রতি ধাপে অংশ নেন, আবার কিছু মানুষ দূর থেকেই মাকে ভক্তি সহকারে প্রনাম জানান। তবে দূর থেকেই হোক আর কাছ থেকেই জগদ্ধাত্রী মায়ের কাছে আমাদের সকলের একটাই প্রার্থনা, মা যেন এই জগতকে পাপের হাত থেকে রক্ষা করেন।
প্রচ্ছদ ছবি সৌজন্যে- সুদীপ্ত চন্দ। মৃৎশিল্পী- চায়না পাল।
Be First to Comment