জন্মদিনে স্মরণঃ মে ঘ না দ সা হা
বাবলু ভট্টাচার্য : বিজ্ঞানের ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম বছর ছিল ১৯১৯ সাল। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন পৃথিবী আলোড়নকারী এক এক্সপেরিমেন্ট করে ঘোষণা দিলেন-আলবার্ট আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি থিওরি প্রমাণিত! যে আইনস্টাইনকে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ চিনতেন, সে আইনস্টাইন রাত পোহাতেই পৌঁছে গেলেন পৃথিবীর ঘরে ঘরে। দুনিয়ার সংবাদপত্রগুলো তাঁকে নিয়ে উঠে-পড়ে লাগল। মানুষ বলতে লাগল- দ্য ম্যান অব এ ট্রু সায়েন্টিফিক প্রফেট!
সেই জোয়ার এসে আছড়ে পড়ল দূর দক্ষিণের বাংলায়। প্রেসিডেন্সি কলেজের কয়েক তরুণকে ছুঁয়ে গেল এক তরঙ্গ—আইনস্টাইনের তরঙ্গ। সে যুবকদের নাম সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মেঘনাদ সাহা ও জ্ঞান ঘোষ। একই ব্যাচের ছাত্র তারা। ত্রিরত্ন! সত্যেন্দ্রনাথ বোস বিএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলেন। এমএসসিতে প্রথম হলেন দুজন—বোস ও সাহা।
বাংলায় তখন স্বদেশি আন্দোলন ও ইংরেজ খেদাও আন্দোলন তুঙ্গে। কিন্তু এই তরুণেরা তখন বিজ্ঞানের নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন। তাদের মগজ জুড়ে বাসা বেঁধেছে আইনস্টাইন, নিলস বোর, ডি ব্রগলি, মেরি কুরি, ম্যাক্স প্লাংক, রাদারফোর্ড ও বোল্টজম্যান প্রমুখ দুনিয়া কাঁপানো বিজ্ঞানীরা।
মেঘনাদ সাহা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন। উঠলেন ইডেন হিন্দু হোস্টেলে। খাবারের সময় উঁচু বর্ণের হিন্দু ছাত্ররা নাক সিটকালেন! সাহার মতো নিম্ন বর্ণের হিন্দুর সঙ্গে তাঁরা খেতে নারাজ! ঢাকায় জন্ম নেওয়া মেঘনাদ সাহাকে সেসব কিছুই স্পর্শ করল না। তিনি তখন জাতপাত থেকে বহুদূরের মানুষ।
সাহা লক্ষ্য করলেন, বিজ্ঞানের সকল ভালো ভালো আর্টিকেল জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে। সুতরাং সেসব আর্টিকেল পড়তে হলে জার্মান ভাষা জানা জরুরি। তিনি নিজে নিজে জার্মান ভাষা শিখলেন। সেই জ্ঞান দিয়ে ছাব্বিশ বছরের মেঘনাদ, তাঁর বন্ধু সত্যেনকে নিয়ে আইনস্টাইনের বই ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন— প্রিন্সিপালস অব রিলেটিভিটি! What a tallented guy! তাদের বইয়ের মাধ্যমে, ভারতবর্ষ আইনস্টাইনকে চিনল নতুন করে। এ জন্যই হয়তো একসময় বলা হতো, বাঙালি আজ যা ভাবে, ভারত তা ভাবে পরদিন।
১৯১৯ সাল যেমন আইনস্টাইনের বছর, তেমনি মেঘনাদ সাহার জন্যও ছিল উজ্জ্বলতম। সাহা ভেবে দেখলেন, আকাশের নক্ষত্রের চিহ্নিত করতে স্পেক্ট্রোসকপি নামে এক টেকনিক ব্যবহৃত হচ্ছে। একেক নক্ষত্র, একেক ধরনের স্পেকট্রা (বর্ণালি) দেয়।
সুপারমার্কেটের প্রতিটি পণ্যের জন্য যেমন নির্দিষ্ট একটা বারকোড আছে, কতগুলো কালো কালো লাইন দিয়ে যেমন প্রতিটি পণ্যকে আলাদা করা যায়, ঠিক তেমনি স্পেকট্রা হলো ফিঙ্গারপ্রিন্ট। একেকটি নক্ষত্র থেকে একেক ধরনের স্পেকট্রা পাওয়া যায়। মেঘনাদ সাহা ভাবলেন, এই স্পেকট্রার সঙ্গে তাপমাত্রার একটা সম্পর্ক আছে। তাপমাত্রার কম-বেশির সঙ্গে পরমাণুর আয়নীকরণের (আয়োনাইজেশন) সম্পর্ক নিবিড়। আর সে আয়নিকরণের সঙ্গে আছে স্পেকট্রার সম্পর্ক।
তিনি সমীকরণ দাঁড় করালেন। সে সমীকরণের নাম হয়ে গেল ‘সাহা আয়োনাইজেশন ইকুয়েশন’। সেই সমীকরণ সহসাই মহাকাশবিজ্ঞানীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। সাহা সমীকরণ দিয়ে নক্ষত্রের তাপমাত্রা ও গঠন সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া সহজ হয়ে গেল। সাহার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপ-আমেরিকার বিজ্ঞানী মহলে। তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে বিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রাচীন সংগঠন রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত করা হলো।
যদিও নোবেল পুরস্কারের জন্য কয়েকবার নমিনেশন পেয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে শেষ পর্যন্ত পুরস্কার হাতে ওঠেনি।
ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে বেশি দিন নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি সাহা। একসময় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। গবেষণা থেকে মনোযোগ কমে আসে। ভারতের বিজ্ঞান ও গবেষণাকে জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করতে শুরু করলেন। বিজ্ঞানের বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছাড়াও রাষ্ট্রীয় বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন।
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে গড়ে তুললেন নিউক্লিয়ার গবেষণাকেন্দ্র। ১৯৫০ সালে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী আইরিন জুলিয়েট কুরিকে দিয়ে সেই গবেষণাকেন্দ্র উদ্বোধন করে চালু করলেন। সে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান নাম হলো সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার রিসার্চ।
মেঘনাদ সাহাকে নিয়ে জনপ্রিয় মার্কিন তরুণ লেখক স্যাম কিন ‘একটি বিস্মৃত নক্ষত্র’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ফিলাডেলফিয়ার কেমিক্যাল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন থেকে।
১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
মেঘনাদ সাহা ১৮৯৩ সালের আজকের দিনে (৬ অক্টোবর) ঢাকার গাজীপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment