শ্রীজিৎ চট্টরাজ : কলকাতা, ২২ মার্চ ২০২২। শহরের সমস্ত কর্কশে , কঠিনে, সিমেন্টে কংক্রিটে,/ ইঁটে, কাঠে, পিচে পাথরে দেওয়ালে দেওয়ালে বেজে উঠল এক দুর্বার উচ্চারণ/ এক প্রত্যয়ের তপ্ত শঙ্খধ্বনি প্রাণ আছে, এখনও প্রাণ আছে, /প্রাণ থাকলেই মান আছে সমস্ত বাধা নিষেধের বাইরেও আছে অস্তিত্বের অধিকার।
অচিন্ত্য সেনগুপ্তের ছন্নছাড়া কবিতার এই পংক্তিগুলি আবার মনে করিয়ে দিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অভিষেক বিশ্বাস ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী কৃষ্টি দাস।অভিভাবকেরা সাধারণত বলে থাকেন, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো উচিত নয়। কিন্তু অভিষেক বা কৃষ্টির অভিভাবকেরা সে কথা বলেননি। কেননা তাঁরা জানেন ঘরের খেয়েই বনের মোষ তাড়ানো দরকার। নাহলে বনের মোষ ঘরে ঢুকে পড়বে। এটা একটা বৌদ্ধিক চেতনা, যে সমাজ ভালো না থাকলে আমিও নিরাপদে থাকবো না। সুতরাং নতুন প্রজন্ম যদি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, আর সেই বঞ্চনার কারণ যদি আর্থিক অসছ্বলতা হয়, তাহলে দেশ উন্নতি করবে না। দেশ উন্নত না হলে সবার নিরাপত্তাই হবে সঙ্কটময়। তাই বিদেশের পড়াশুনো ছেড়ে বা মোটা মাইনের কর্পোরেট চাকরির নিরাপত্তার ঘেরা টোপ উপেক্ষা করে শুধু রাজ্যের প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার জন্য বিনি পয়সার শিক্ষা অ্যাপ নিয়ে কেন হাজির হবে আজকের মেধাবী নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা?
গত ২১ মার্চ সোমবার বিকেলে কলকাতার প্রেসক্লাবে ক্লাসরুট নামে এক বিনি পয়সার অ্যাপ নিয়ে এসেছেন একদল নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে। মূলত সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রেক্ষিতে দ্রুত অ্যাপটি প্রকাশ হলো। ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য ২৫টি বিষয়ের সহজ সাহায্য থাকবে এই অ্যাপে। থাকছে প্রশ্ন করার সুযোগ। যা দ্রুত মীমাংসা করে দেওয়া হবে। থাকছে বিভিন্ন বিভাগ। বৈঠকখানা, একসাথে অর্থাৎ গ্রুপ স্টাডি করার সুযোগ। থাকছে বার্তালাপ। অর্থাৎ চ্যাট করার নতুন অভিজ্ঞতা।
ইউনিসেফ প্রধান হেনরিয়েটা ফোবে জানিয়েছেন, বিশ্বে ১৫০ কোটি ছাত্রছাত্রী করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ভারতে এই সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। তবে সমীক্ষার বাইরেও রয়েছে এক বিশাল সংখ্যা। অন্যতম কারণ- শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঠিক চেতনার অভাব, গৃহে শিক্ষার পরিবেশের অভাব,সর্বোপরি অনলাইন শিক্ষাক্রমের অন্যতম উপাদান ইন্টারনেট সংযোগে ঘাটতি। আবার ইন্টারনেটের মূল্যবৃদ্ধিও এক বড় কারণ। ক্লাসরুট অ্যাপের নির্মাণ যাঁদের উদ্যোগে সেই অভিষেক বিশ্বাস ও কৃষ্টি দাস জানালেন,এখনও এক টাকা খরচ করে করোনা মাস্ক কেনা যখন বিলাসিতা,সেখানে বহুমূল্যের শিক্ষা অ্যাপ কিনে পড়াশুনো করা স্বপ্নেরও অতীত। সেই মুস্কিল আসানে ক্লাসরুট অ্যাপের আত্মপ্রকাশ। কর্পোরেট শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রান্তিক মানুষের পাশে থেকে ক্লাসরুট রাজ্যের আর্থিক সংকটে আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের কাছে আশীর্বাদ। অ্যাপনির্ভর শিক্ষাক্রম যখন করোনা পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে, তখন ভবিষ্যত প্রজন্মের মানুষদের শিক্ষিত করার আন্দোলনে ক্লাসরুট হবে সহায়ক। এমনই দাবি, অ্যাপ নির্মাণের বিশ্বকর্মা অভিষেক বিশ্বাসের। অ্যাপ প্রকল্পে থাকছে না কোনও ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপন। নিজেদের খরচে ক্লাস রুট প্রকল্পে যুক্ত ছেলেমেয়েরা নিজেরাই কনটেন্ট তৈরি করছেন। শিক্ষার্থীদের যেকোনও মুস্কিল আসানে তাঁরা দায়বদ্ধ। বাজারি বিজ্ঞাপন না করেও ফেসবুক মারফত সংবাদটি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। মিলছে অপ্রত্যাশিত সাড়া। আগামীদিনে এই অ্যাপের সম্প্রসারণ ঘটানো হবে অন্য ক্লাসের শিক্ষার্থীদেরও জন্য।
Be First to Comment