শু ভ জ ন্ম দি ন অ রু ন্ধ তী রা য়
“যদি আপনি ধার্মিক হয়ে থাকেন, তাহলে মনে রাখুন, এই বোমা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের চ্যালেঞ্জ। যেন খুব সহজ ভাষায় বলা যায়, তুমি যা কিছু সৃষ্টি করেছো, সে সব কিছু ধ্বংসের ক্ষমতা আমাদের আছে। আর যদি আপনি ধার্মিক না হন, তাহলে এভাবে ভাবুন, আমাদের ৪৬০ কোটি বছরের পুরোনো এই পৃথিবী এক বিকেলেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।”
——- অরুন্ধতী রায়
বাবলু ভট্টাচার্য : মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে যারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন কলম, যাদের কলমের কালির ছোঁয়ায় অঙ্কিত হয়েছে নির্যাতিত মানুষের করুণ ছবি, যাদের ক্ষুরধার লেখনী পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে এক আতঙ্কের নাম, তাদেরই একজন অরুন্ধতী রায়।
বুকার পুরস্কার বিজয়ী একজন বিখ্যাত ভারতীয় উপন্যাসিক এবং মানবাধিকারকর্মী। তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’-এর জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন পরিবেশ এবং মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকাণ্ডে সঙ্গে জড়িত রয়েছেন তিনি।
অরুন্ধতী রায়ের বাবা রঞ্জিত রায় একজন হিন্দু বাঙালি এবং মা ম্যারি রায় একজন সিরিয়ান খ্রিস্টান। রঞ্জিত রায় ছিলেন একজন চা শিল্পপতি। আর ম্যারি রায় ছিলেন একজন নারী অধিকারকর্মী। যিনি ভারতীয় খ্রিস্টান নারীদের পিতার সম্পত্তিতে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন।
দুই বছর বয়সে বাবার সঙ্গে মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। পরে মা ছোট অরুন্ধতী ও তার ভাইকে নিয়ে কেরালায় ফিরে আসেন। দুই সন্তান নিয়ে মায়ের সংগ্রাম শুরু হয়।
অরুন্ধতীর শৈশব কেটেছে কেরালার আয়ামানাম এলাকায়। স্থাপত্য বিদ্যা নিয়ে দিল্লির পরিকল্পনা ও স্থাপত্য বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। স্থাপত্য বিদ্যায় পড়লেও শুরুর দিকে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র শিল্পে কাজ করা শুরু করেন।
১৯৮৫ সালে ‘মাসি সাহিব’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এরপর চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার কাজে হাত দেন। ‘ইলেকট্রিক মুন’ (১৯৯২) এবং ‘ইন হুইচ অ্যানি গিভস ইট দোস ওয়ান্স’ (১৯৮৯) চলচ্চিত্র দু’টির চিত্রনাট্য লেখেন তিনি।
‘ইন হুইচ অ্যানি গিভস ইট দোস ওয়ান্স’ চলচ্চিত্রটি স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রী হিসেবে তার অভিজ্ঞতার আলোকেই নির্মিত। আর এ ছবিতে অরুন্ধতী নিজেও অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের জন্য ১৯৮৮ সালে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
একজন ধর্ষিতা নারী ফুলন দেবীর জীবনী নিয়ে ‘ব্যান্ডিট কুইন’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন শেখর কাপুর। ১৯৯৪ সালে এই ছবির সমালোচনা করে তিনি বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন।
‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান রেপ ট্রিক’ শিরোনামে ছবির পর্যালোচনায় তিনি অনুমতি ছাড়া একজন জীবন্ত নারীর ধর্ষণের ঘটনাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার অভিযোগ করেন।
তিনি ১৯৯২ সালে ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে উপন্যাস লেখার কাজ শেষ হয় এবং বইটি বাজারে আসে ১৯৯৭ সালে। এই বইটি মূলত তার আত্মজীবনীমূলক একটি উপন্যাস। যেখানে তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার আয়ামানামের শৈশবের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
১৯৯৭ সালে এই বইয়ের জন্য তিনি সাহিত্যের অস্কারখ্যাত ‘বুকার পুরস্কার’ লাভ করেন।
বইটিকে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস অসাধারণ, নৈতিকভাবে তেজস্বীপূর্ণ এবং কল্পনার ক্ষেত্রে অধিক নমনীয় বলে বর্ণনা করেছে।
তিনি ‘পুঁজিবাদ’, ‘এক ভৌতিক কাহিনী’, ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’, ‘পাওয়ার পলিটিকস’, ‘দ্য অ্যালজেব্রা অব ইনফিনিট জাস্টিস’, ‘ওয়ার ওয়াক’, ‘পাবলিক পাওয়ার ইন দ্য এজ অব অ্যাম্পায়ার’, ‘ফিল্ড নোটস অন ডেমোক্র্যাসি’, ‘ব্রোকেন রিপাবলিক : থ্রি অ্যাসে’- সহ বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। বইগুলোতে পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি।
২০১৭ সালে ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমুস্ট হ্যাপিনেস’ শিরোনামে তার দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।
এছাড়া বিভিন্ন পরিবেশবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও তিনি জড়িত। তিনি ভারতের নর্মাদায় বাঁধ নির্মাণের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এ জন্য তাকে আদালতে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। এছাড়া ভারতের পরমাণু অস্ত্র এবং ভারতে মার্কিন পাওয়ার জায়ান্ট ‘এনরন’-এর কার্যক্রমের সমালোচনা করে তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন।
মাওবাদীদের সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করায় ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছেন। ২০১০ সালে কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করে মন্তব্য করায় অল্পের জন্য তিনি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ থেকে রেহাই পান।
যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানদের মধ্যে হওয়া শান্তি আলোচনায় আফগান নারীদেরকে সম্পৃক্ত করার জন্য দাখিল করা এক পিটিশনে তিনি স্বাক্ষর করেন।
মানবাধিকার নিয়ে তার এই অসামান্য কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০২ সালে লান্নান ফাউন্ডেশন কর্তৃক ‘সাংস্কৃতিক মুক্তি পুরস্কার’ পান তিনি। ২০০৪ সালে ‘সিডনি শান্তি পুরস্কার’, ২০০৬ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব লেটারস কর্তৃক ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ এবং ২০১১ সালে ‘নরম্যান মেইলার পুরস্কার’ লাভ করেন অরুন্ধতী।
তবে শিল্প শ্রমিকদের প্রতি ভারত সরকারের সহিংস আচরণ ও নিষ্ঠুর নীতি, সামরিকীকরণ বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক নব্য-উদারীকরণ নীতির প্রতিবাদে তিনি ২০০৬ সালে দেয়া ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ নিতে অস্বীকার করেছিলেন।
এভাবেই বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকারের জন্য এখনো নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন একবিংশ শতাব্দীর কলম যোদ্ধা অরুন্ধতী রায়।
অরুন্ধতি রায় ১৯৬১ সালের আজকের দিনে (২৪ নভেম্বর) ভারতের মেঘালয়ের শিলং-এ জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment