জন্মদিনে স্মরণঃ রা হু ল দে ব ব র্ম ণ
বাবলু ভট্টাচার্য : যিনি কাঁদতেনও সুর করে, তিনি তো সুরেই ডুবে থাকবেন। শুধু ডুবেই থাকেননি, ডুবিয়ে ছেড়েছেন আসমুদ্র হিমাচলকে। তিনি সুরকার, গায়ক রাহুলদেব বর্মন।
তাঁর বাবা সঙ্গীতজ্ঞ শচীনদেব বর্মন এবং মা মীরা দাশগুপ্ত ছিলেন গীতিকার। তাঁর ঠাকুরমা ডাকতেন ‘টুবলু’ নামে। কেউ কেউ বলে থাকেন স্বরলিপির ‘পা’ ধ্বনি দ্বারা রাহুল একদম ছোটোবেলায় ক্রন্দন করতেন তাই তার নাম পঞ্চম ধ্বনি অনুযায়ী ‘পঞ্চম’ বা ‘প’ অক্ষর থেকে পঞ্চম রাখা হয়। কেউ কেউ আবার এও বলেন যে অভিনেতা অশোক কুমার রাহুলের ডাকনাম পঞ্চম রেখেছিলেন।
শৈশবের যাবতীয় দৌরাত্ম্যের পাশাপাশি চলছিল পড়াশোনা, সঙ্গে সঙ্গীত শিক্ষা, তবলা, সরোদের তালিম। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ব্রজেন বিশ্বাস, উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের মতো ব্যক্তিদের।
মাত্র ন’বছর বয়সে ‘ফ্যান্টুস’ ছবির একটি গানে প্রথম সুর দেন রাহুল। সে ছবি মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালে। এরপর ১৯৬১ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘ছোটে নবাব’। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে রাহুলদেব বর্মণের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি।
১৯৬৫ সালে মেহমুদ সাব ‘ভূত বাংলা’ ছবির মিউজিকের দায়িত্ব দেন অন্তরঙ্গ বন্ধু পঞ্চমের হাতে। পঞ্চম ঠিক করেন এলভিস প্রেসলির দৌলতে সেই সময়ে প্রচণ্ড জনপ্রিয় টুইস্ট নাচের ওপর একটা গান কম্পোজ করবেন, আর যাতে কোমর দোলাবেন মেহমুদ সাহাব নিজে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, লিখে ফেললেন ‘আও টুইস্ট করে’। আর গাইলেন মান্না দে।
বাবা শচীনদেব বর্মন অভিমানে অনেক দিন কথা বলেননি এই গান শুনে। শচীন কর্তার মনে হয়েছিল এই গানের সুর মোটেই ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না।
ততদিনে পঞ্চম বানিয়ে ফেলেছেন ‘তিসরি মঞ্জিল’- এর বিখ্যাত সব গানের সুর। ‘আজা আজা ম্যয় হুঁ পেয়্যার তেরা’, ‘ও হাসিনা জুলফোওয়ালি জানে জাঁহা’ যা ছিল পশ্চিমী ক্যাবারের অনুকরণে বানানো। এর পাশাপাশি আরো দুটো গান ছিল ‘ও মেরে সোনা রে সোনা রে’ ও ‘তুমনে মুঝে দেখা’ যা দিয়ে পঞ্চম মিউজিক ডিরেক্টর হিসাবে প্রথমবারের জন্য সাফল্যের সিঁড়িতে পা রাখেন।
তারপর শুরু হয় আর ডি-র যুগ। বাবা শচীনদেব বর্মনের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজের একটা আলাদা পরিচিতি তৈরি করেন পঞ্চম। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকের বলিউড জেনে যায় মাঝারিমাপের চিত্রনাট্যও পঞ্চমের সুরের যাদুতে হয়ে ওঠে মিউজিক্যাল হিটস।
নিজের জীবনের বহু ঘটনা থেকেও পেশাদার জগতের গান বেঁধেছেন আরডি। তাঁর প্রথম স্ত্রী রিতা প্যাটেল। তাঁর সঙ্গে দার্জিলিঙে আলাপ। রীতা নাকি আরডি-র গানের ফ্যান ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে এক দিন পঞ্চমের সঙ্গে ছবি দেখতে যান। ১৯৬৬-তে বিয়ে। যদিও ৭১-এই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বিবাহ-বিচ্ছেদের পরের বছর ‘পরিচয়’ ছবির জন্য ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’ গানটি লিখেছিলেন পঞ্চম। ১৯৮০-তে আশা ভোঁসলেকে বিয়ে করেন তিনি।
সত্তরের পঞ্চম শুধু বিদেশি সংগীত নিয়ে পড়ে থাকেননি, শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়েও বেশ কিছু কাজকর্ম করেছিলেন। পাশে পেয়েছিলেন গুলজার সাহেবের লেখা আর কিশোর কুমারের কণ্ঠ। আর ডি, গুলজার আর কিশোর কম্বিনেশন সমস্ত ব্লকবাস্টার। কি সব গান বেরিয়ে এসেছিল এই তিনজনের যুগলবন্দীতে! ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’, ‘ও মাঝি রে আপনা কিনারা’, ‘তেরে বিনা জিন্দেগী সে কোয়ি’, ‘তুম আ গ্যায়ে হো নুর আ গ্যায়া হ্যায়’, ‘আনেওয়ালা পল জানেওয়ালা হ্যায়’। বলে শেষ করা যাবে না।
শুধু রাগপ্রধান গান গাওয়া ছাড়াও কিশোরের গলায় ও রাজেশ খান্নার লিপে আর ডি ভারতবর্ষকে সুর মূর্ছনায় ডুবিয়ে রেখেছিলেন একটা গোটা দশক।
‘অমর প্রেম’ সিনেমার কথাই ধরুন। সিনেমার সমস্ত গান আজও মানুষ সমান আগ্রহ নিয়ে শোনেন। এ সময় বেশ কিছু পরীক্ষামূলক কাজের মাধ্যমে তিনি পিছনে ফেলে দেন তাঁর সমসাময়িক সঙ্গীত পরিচালকদের।
কিছু গানের শুরুতে এমন কিছু আওয়াজ তৈরি করেন যা সেইসময় বসে করা দূরে থাক, ভাবতেও কেউ পারতেন না। যেমন, ‘শোলে’ সিনেমায় ‘মেহবুবা মেহবুবা’ গানের আগে ফাঁকা বোতলের শব্দ, ‘পড়োসন’ সিনেমায় ‘মেরে সামনেওয়ালি খিড়কি’ গানের আগে চিরুনি ঘষার শব্দ, ‘ইঁয়াদো কি বারাত’ সিনেমায় ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে যো দিল কো’ গানের আগে বোতলের গায়ে কাঁটা চামচ ঠোকার শব্দ।
হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে ‘শোলে’ হল এমন একটা সিনেমা যার পর থেকে হিন্দি সিনেমার একটা নতুন ধারা তৈরি হয়ে ছিল। সিনেমার গান নিয়ে কিছু বলার নেই। সব গানের মধ্যে সেরা ছিল ‘মেহবুবা মেহবুবা’ গানটি।
গানটি পঞ্চম লিখেছিলেন আশা ভোঁসলেকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য। কিন্তু আশাজি বেঁকে বসেন ওই চড়া সুর শুনে। তখন নিজেই গানটি রেকর্ড করেন আর সিনেমায় চালিয়ে দেন যা সুপার ডুপার হিট হয়ে যায়। শোলের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বানিয়েছিলেন হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘গুড ব্যাড আগলি’-র অনুকরণে।
সত্তরের দশকে ভারতীয় সিনেমার গানে প্রায় রাজত্ব করে গিয়েছেন আর ডি; বিশেষত হিন্দি ছবির গানে। সেই রাহুলদেবকে আশির দশকে অপেক্ষা করতে হত কাজের জন্য। তবুও আশির দশকে যে সমস্ত ছবিতে তিনি সঙ্গীত দিয়েছিলেন তা একের পর এক হিট। তালিকার দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে- ‘শান’, ‘বরসাত কি এক রাত’, ‘রকি’, ‘কালিয়া’, ‘সত্তে পে সত্তা’, ‘সনম তেরি কসম’, ‘মাসুম’, ‘বেতাব’, ‘জিভা’, ‘সাগর’, ‘ইজাজত’, ‘পরিন্দে’।
৪ জানুয়ারি ১৯৯৪ সালে তিনি ৫৪ বছর বয়সে মুম্বাইয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
রাহুলদেব বর্মণ ১৯৩৯ সালের আজকের দিনে (২৭ জুন) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment